১২তম বর্ষ : অনলাইন ৫ম সংখ্যা
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
সম্পাদক: প্রণব ঘোষ ও শুভদীপ মাইতি
কানপাড়া : সোমড়া : বলাগড় : হুগলী
পশ্চিমবঙ্গ : ৭১২১২৩ : ভারতবর্ষ
কথা : ৯৪৩৪৯৭৭৮৩০ ৯০০২৫৮৫৮৩২
ইমেল: choutishaprokason@gmail.com
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
এই সংখ্যা যাদের কলমে সমৃদ্ধ:
১ নভেম্বর ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয় ইতিহাস : পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
গুচ্ছ কবিতা: বিকাশ চন্দ, আবদুস সালাম।
কবিতা: সমর ভূষন দে, দেবাশিস মিশ্র, রতন কুমার নাথ, বিরথ চন্দ্র মন্ডল, তপন কুমার রায় ও প্রণব ঘোষ।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
ভারতবর্ষের প্রথম ১ নভেম্বর অমর ভাষা শহিদ স্মারক স্তম্ভ।
উদ্বোধক: কবি অরুন কুমার চক্রবর্তী ও সাহিত্যিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
ভাস্কর: আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী রামকুমার মান্না।
স্থান: কোলড়া বাস স্ট্যান্ড, সোমড়া, বলাগড়, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
আমাদের কথা:
দেখতে দেখতে ১২ তম বর্ষে পদার্পণ করল
“চৌতিশা সাহিত্য পরিষদ”। মাঝে ১ নভেম্বর ২০১৫ ” মাতৃভাষা স্মারক স্তম্ভ” প্রতিষ্ঠা। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কেন ১ নভেম্বর” ভাষা স্মারক স্তম্ভের” স্থাপনা। এই সংখ্যায় যার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। একটু পিছনের দিকে ফিরে যাচ্ছি, অনেকেই জানেন ১ নভেম্বর: ” ভারতের প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিজয় ইতিহাস” নিয়ে ২০১৫ খ্রী: শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য সমৃদ্ধ পুস্তক প্রকাশ করি। ভূমিকায় বিস্তারিত আলোচনা আছে। আসলে ভাষা স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব তাঁর কাছ থেকে আসে, প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, কথামতো প্রায় তিন দিন গৃহবন্দী থেকে উল্লিখিত পাণ্ডুলিপি সর্বস্বত্বে ” চৌতিশা” কে দেন। যা পুস্তক আকারে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ১০ অক্টোবর ২০১৫ । ১ নভেম্বর ২০১৫ । মাতৃভাষা ভাষা স্মারক স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা। উদ্বোধক: কবি অরুন কুমার চক্রবর্তী ও সাহিত্যিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর: আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী রামকুমার মান্না, সহযোগিতায়: কোলড়া, বালিগড়ী বাজার কমিটি এবং সোমড়া ২ নম্বর পঞ্চায়েত। যার ফলস্বরূপ ভারত, বাংলাদেশের সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবী মহল তাঁদের ভাবনায় আনেন । আমরা গর্বিত ভারতবর্ষে প্রথম ১ নভেম্বর অমর ভাষা শহিদ স্মরণে ভাষা স্মারক স্তম্ভ” স্থাপন করতে পেরে। সুখের বিষয় ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠক এই দিনটিকে অমর ভাষা শহিদদের এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনে সামিল প্রেমিকদের স্মরণে গানে-কবিতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলেছেন। বাঙালি হিসাবে একজন ভারতীয় হয়ে ধন্য যে আজ বাংলাদেশেও প্রথম এই দিনটিতে বাংলা ভাষার শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। “চৌতিশা ” সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আজ ” মাতৃভাষা ভাষা স্মারক স্তম্ভ” ৭ ম বর্ষে পদার্পণ করল। শ্রী চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন বিগত বামফ্রন্ট রাজত্বকাল মানভূমে ” ভাষা স্মারক স্তম্ভে”র প্রতিকৃতির নির্মান শুরু হয়েছিল যা আজও অসমাপ্ত। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন রাখছি সম্পূর্ণতা পাওয়ার জন্য।
আজকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে “চৌতিশা”র অনলাইনের মাধ্যমে তুলে ধরছি অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ২ য় খণ্ডের ১ নভেম্বরের ইতিহাস এবং বিশিষ্ট কবিদের কবিতা। শেষ করছি, করোনা আবর্তে মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত সমগ্র মানবজাতিকে বিষাদের শুভ বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা ও সুস্থ থাকার কামনায়।
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
●●●●● ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয় ●●●●●
□ পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
মানভূমের অতীত কথা:
■■■■■■■■■■
ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে মানভূমের ইতিহাসের সূচনা মুঘোল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের এবং তাঁর সহযোগীদের বক্সারের যুদ্ধে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে যুদ্ধে হেরে যাবার মধ্যেই এই যুদ্ধের পরে কোম্পানি সুবে বাংলার (বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ) দেওয়ানি লাভ করে।
এরপরে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইন পাশ করে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য কোম্পানির প্রশাসন, বাংলার ভৌগোলিক এলাকার প্রশাসনিক পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিল। জন্ম হল মানভূমের।
মানভূম জেলার জেলা সদর হল মানবাজার। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ। মানভূমের সদর হল পুরুলিয়া।
বর্তমানে এই জেলার মধ্যে পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলা ,ধানবাদ,ধলভূম ,সারাইকেলা,খরসুঁয়া জেলা ( ঝাড়খন্ড জেলার মধ্যে ) পড়ে।
১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ গুলিতে মানভূমের ক্ষেত্রমান বা আকার বারে বারে কমানো হতে থাকে। যখন মানভূম জেলা গঠিত হয় তখন এর ক্ষেত্রমান ছিল২০,৪৫০/৫ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এর আয়তন দাঁড়ায় ১০,৬৫০ বর্গকিলোমিটার।
মানভূমকে বাংলা থেকে ভাগ করার ইতিবৃত্ত:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ। লর্ড কার্জণ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু দেশের মানুষের প্রবল চাপের মুখে, আন্দোলনের মুখে তাকে সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়। কিন্তু ২২ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশ ভেঙে দুটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হল। (১) বাংলা এবং (২) বিহার-উড়িষ্যা।
তথ্য বলছে মানভূমের জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ ছিল বাঙালী। কিন্তু তবু এই জেলাকে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হল।
বাংলার বৌদ্ধিক মানুষ,সাধারণ মানুষ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করল। উল্লেখ করা যায় বিহারের সচ্চিদানন্দ সিংহ, মোহাম্মদ ফকরুদ্দিন, দীপনারায়ণ সিংহর মত মানুষেরাও এর প্রতিবাদ করেছিলেন তখন। এই দীপনারায়ণ সিংহই পরবর্তী সময় বিহারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
উল্লেখ করা যায় জাতীয় কংগ্রেস কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক অঙ্গরাজ্য গঠনের আদর্শেই বিশ্বাস রাখত। মহাত্মা গান্ধী বা জওহরলাল নেহেরুও এই মতেই বিশ্বাস রাখতেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশন বসেছিল নাগপুরে। এই অধিবেশনে ভাষা ভিত্তিক অঙ্গ রাজ্য গঠনের ওপর জোড় দেওয়া হয়। সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবার পরে ভাষা ভিত্তিক অঙ্গরাজ্য গঠন করা হবে। নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন সি. বিজয়রাঘবাচার্য। (Memorable Sessions Of the Congress in the pre-Independence years-All India Mahila Congress..)
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ। এবার প্রশাসনিক সুবিধের দিকে নজর দিয়ে ” বিহার-উড়িষ্যা ” প্রদেশকে দু’ভাগে ভাগ করে দুটি প্রদেশের জন্ম দেওয়া হল―
(১ ) বিহার (২ ) উড়িষ্যা। অবাক কান্ড হল মানভূমের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি,তবু মানভূমকে জুড়ে দেওয়া হল বিহারের সাথে। উল্লেখ করা যায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যে আদম সুমারি হয়েছিল সেখানে তথ্য বলছে মানভূমের ৮৭% মানুষই কথা বলে বাংলায়।
মানভূমের বাঙালিদের দুঃখ কর অবধান:
■■■■■■■■■■■■■■■■■
সেই সময়ে কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি বিহারী এবং হিন্দী ভাষীদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই তৈরি করলেন একটি সংগঠন – ” মানভূম বিহারী সমিতি”। সেই সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভাই ব্যারিস্টার পি.আর দাস বাঙালিদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঙালিদের আহ্বাণ করলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিল মানভূমের বাঙালিরা। বাঙালিদের সমন্বয়ের জন্যই ব্যারিস্টার পি. আর. দাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠলো বাঙালিদের সংগঠন ” মানভূম বাঙালি সমিতি “।
মানভূমে হিন্দির অধিক প্রসারের দিকে লক্ষ রেখে মানভূমে সরকার গড়ে তুলতে থাকলো একের পর এক হিন্দি স্কুল। বাংলা মাধ্যম স্কুল গঠনের দিকে সরকার দৃকপাতই করলো না। বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাষা রক্ষার তাগিদে বাঙালিরা নিজেদের অর্থ খরচ করে কিছু বাংলা মাধ্যম স্কুল গড়ে তুলতে থাকলো মানভূমের বাঙালি অধ্যুসিত অঞ্চলে।
স্বাধীন হল দেশ / ঘুচলো না ক্লেশ:
■■■■■■■■■■■■■■
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা পেল ভারতবর্ষ। এবার ভারতের নানা প্রান্তের নানা ভাষাভাষীর মানুষেরা ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠন নিয়ে নানান দাবি তুলতে থাকলো। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজী এবং কংগ্রেস মনে করলো যদি এভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবীকে মান্যতা দেওয়া হয় তবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হতে পারে। ফলে কংগ্রেস চুপ রইলো এই সমস্ত দাবীর ক্ষেত্র গুলিতে।
ধর কমিশন:
■■■■■■■
দেশের রাষ্ট্রপতি তখন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি ১৭ জুন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি গঠন করলেন ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিষয় গুলিকে খতিয়ে দেখার জন্য। কমিটির নাম রাখা হল LINGUISTIC PROVINCES COMMISSION (S K DAR COMMISSION )। কমিটি গঠিত হল অবসরপ্রাপ্ত জজ( এলাহাবাদ হাইকোর্ট) এস .কে ধর,আইনজ্ঞ
J. N. LAL । অবসরপ্রাপ্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অফিসার পান্নালাল লাল কে নিয়ে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ধর কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করলো সরকারের কাছে। ধর কমিশনের রিপোর্টে বলা হল কেবলমাত্র ভাষার ওপর ভিত্তি করে বা এর ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য গঠন করা হলে তা দেশের বৃহৎ স্বার্থের বিরোধী হবে। তারা বললো” ” the formation of provinces on exclusively or even mainly linguistic considerations is not in the large interests of the India nation. “
ধর কমিশন এও বলে যে দেশের স্বার্থের জন্য দেখতে হবে―
( ১ ) ভৌগোলিক নৈকট্য।
( ২ ) প্রশাসনিক সুবিধা।
( ৩ ) অর্থনৈতিক সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ।
এর ওপর জোড় দিয়েই অঙ্গরাজ্য পুনর্গঠন করা উচিত।
এই ধর কমিশনের রিপোর্ট দেশের জনগণের মধ্যে একটি বিরূপ ধারণার জন্ম দিল। চারিদিকে এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো মানুষ।
জে. ভি .পি কমিটি:
■■■■■■■■■
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ। কংগ্রেসের অধিবেশন বসল জয়পুরে। সেখানে এই একই বিষয়ে তৈরি হল একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। কমিটির সদস্য হলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া। কমিটির নাম দেওয়া হল জে .ভি . পি কমিটি।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল এই কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। সেখানে বলা হয় – যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাই যদি জনগণের আকাঙ্খা প্রবল ও দাবি জোরালো হয় তবে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবো। দেশের সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনার প্রয়োজন হয় সেখানে কিছু ছাড় দেওয়া হবে।
মানভূমে বিহারী নির্যাতন:
■■■■■■■■■■■
সে সময়কার কেন্দ্র সরকার যে রাজ্যগুলিকে ভাষাভিত্তিক জায়গা থেকে পুনর্গঠন করবেন বা খতিয়ে দেখবেন রাজ্য গুলির ভাষা কেন্দ্রিক বিষয়, সেই সময় কেন্দ্র সরকার দেখছে রাজ্য গুলিতে জনগণের মাতৃভাষা সুরক্ষিত কিনা, তখন বিহার সরকার ঘোষণা করে দিল সেখানকার রাজ্যভাষা হবে একমাত্র হিন্দি।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তখন শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। সরকার নির্দেশিকা জারি করলো। নির্দেশিকায় বলা হল-
প্রথমত- প্রাথমিক স্তর থেকেই পড়ুয়াদের শুধুমাত্র পড়তে হবে হিন্দিতে। হিন্দি ছাড়া অন্য কোন ভাষায় পাঠ দান বা পাঠ গ্রহণ চলবে না।
দ্বিতীয়ত- সমস্ত স্কুল গুলিতে স্কুলের যে সাইনবোর্ড থাকবে তাতে কেবলমাত্র হিন্দিতেই স্কুলের নাম লেখা যাবে।
তৃতীয়ত- কোন রকম বাংলা প্রর্থণা গান গাওয়া যাবে না। গাইতে হবে রাম ধূন। (সার্কুলার/বিদ্যালয় পরিদর্শক/নং ৭০০/৫ আর/তাং ১৮ মার্চ,১৯৪৮)।
চতুর্থত- বাঙালিদের সব সময়ে বাসস্থানের নথি (ডেমিসাইন সার্টিফিকেট ) নিয়ে সব জায়গায় যেতে হবে। কতৃপক্ষ চাইলে তা দেখাতে হবে।
পঞ্চমত- সরকারের সমস্ত রকম কাজ কর্মের ভাষা হিন্দিতে করতে হবে। অন্য ভাষায় সরকারি কাজ করা যাবে না।
মানভূমের বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াই শুরু হল। উল্টোদিকে বিহার সরকার বাংলা ভাষা বিরোধী জান্তব আইন গুলিকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেখানকার বাঙালিদের ওপর।
লোকসেবক সংঘের জন্ম:
■■■■■■■■■■■■
মানভূম জেলা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। তিনি পদত্যাগ করলেন কংগ্রেস থেকে। পদত্যাগ করলেন বিভূতিভুষণ দাশগুপ্ত, অরুণচন্দ্র ঘোষের মত কংগ্রেসের মানভূম এর আরো ৩৭ জন গান্ধীবাদী নেতা। এঁরা প্রত্যেকেই গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। গঠন করা হল নতুন রাজনৈতিক দল “লোকসেবক সংঘ”। মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের নতুন অধ্যায় শুরু হল।
এই সময় নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত “মুক্তি” পত্রিকায় বাংলা ভাষীক মানুষের ওপর বিহারী অত্যাচার এবং বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের তীব্রতার নানা খবর প্রচার করা হয়েছে। আর এগুলি সেই সময়ের বাংলা ভাষা আন্দোলনের দলিল হয়ে আছে বাঙালির মননে।
মুক্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে বরাবাজার থানার হেরবনা গ্রামে সরকারি ধান্যগোলা থেকে অনুদান দেবার সময় বাংলায় লেখা দরখাস্ত গুলি বাতিল করে দেওয়া হয়। আবেদনকারীদের হিন্দিতে দরখাস্ত লিখতে বাধ্য করা হয়।
ঝরিয়া দেশবন্ধু সিনেমা হলে বিজ্ঞাপন দেখাবার সময় দেখানো হতো-
HINDI IS THE MOTHER LANGUAGE OF MANBHUM.
মানৃভূমের যেখানে সেখানে ঘোষণা করা হতো-
“মানভূম বঙ্গাল মে নহী জায়েঙ্গে, জানে পর খুন কে নদী বহা দেঙ্গে। “
লোকসভায় মানভূমের প্রসঙ্গ:
■■■■■■■■■■■■■
ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মানভূম, সেরাইকেল্লা, খরসোয়ানের আন্দোলনকে বিহারের হিন্দি প্রেমি সরকারের জঘন্য আচরণকে মানতে পারা যায়না বলে জওহরলাল নেহেরুকে জানালেন সুচেতা কৃপালনী, এন .সি. চ্যাটার্জী সহ পাঁচজন সাংসদ। আলোচনার তারিখ -২৮ ফেব্রুয়ারি ,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ।
মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পত্র পত্রিকা:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সমর্থণ করে বেশকিছু পত্র পত্রিকায় জ্বালাময়ী কলাম প্রকাশিত হতে থাকে সেই সময়। এই লেখাগুলি মানুষের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বালতে সহযোগিতা করেছিল তখন। তেমন কিছু পত্রিকার নাম আমরা এইভাবে উল্লেখ করতে পারি –
( ১ ) মুক্তি
( ২ ) মর্মবাণী
( ৩ ) কল্যাণবার্তা
( ৪ ) হরিজন-কল্যান সংবাদ
( ৫ ) পল্লীসেবক
( ৬ ) তপোবন
( ৭ ) অগ্রগামী।
আবার এর উল্টো ছবিও সে সময় দেখা যায় মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে। বেশ কিছু হিন্দি পত্রিকাতে মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে প্রায় উপহাসের সুরে বেশ কিছু কলাম প্রকাশ পায় সে সময়। তেমন কিছু পত্রিকার নাম আমরা এইভাবে উল্লেখ করতে পারি-
( ১ ) নিরালা
( ২ ) প্রগতি
( ৩ ) নির্মাণ
( ৪ ) জনসেবক
( ৫ ) সমবেত।
সত্যাগ্রহের পথে:
■■■■■■■■
লোকসেবক সংঘ বাংলা ভাষার মর্যাদার রক্ষার্থে শুরু করলো সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচী। এই আন্দোলনে একই সাথে চলতে থাকলো সভা-সমিতি -সমাবেশ। চলতে থাকলো গ্রাম ভিত্তিক মিছিলের কর্মসূচী। ঘরে ঘরে পালিত হতে থাকলো অরণ্ধন কর্মসূচী।
এরই মধ্যে পশুর মত হিংস্র হয়ে উঠলো তখনকার বিহার সরকার। মানভূমের মানুষদের না খাইয়ে মারার জন্য মানভূমে চাল আমদানী বন্ধ করে দিল বিহার সরকার। আন্দোলন কারীরা বাঁকুড়া থেকে চাল এনে খাদ্য সমস্যা মেটাতে চাইলো। সমস্ত মানভূম জুড়ে শুরু হল খাদ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন।
এবার বিহার সরকার চাষ বাস বন্ধ করে দেবার জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পরোয়া না করে প্রকাশ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয় শুরু করলো। এই আন্দোলনকে বলা হল হাল-জোয়াল সত্যাগ্রহ আন্দোলন।
বিহার সরকার বাংলা ভাষীক মানুষদের ভাষা আন্দোলনের যে কোন রকম সভা সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। এতে মানুষ আরো বিরক্ত হয়ে উঠলো। মানুষ ক্ষেপে গেল। আন্দোলনের গতি আরো তীব্রতা পেল সে সময়।
হিন্দি সন্ত্রাসবাদ:
■■■■■■■■■
বিহার সরকার সে সময় ছাত্র শিক্ষক ছাড়াই গোয়ালঘরে বা বাড়ির বৈঠকখানায় রাতারাতি গজিয়ে তুলতে থাকলো হিন্দি স্কুল।
সার্কুলার নং ১/ ৬-৫-৪৮, ১৮/০৩/৪৮, শ্রীকানাইলাল, ডি .আই অফ স্কুল ; বিষয়- ৭২ টি আদিবাসী স্কুলকে হিন্দি স্কুলে পরিণত করা। আবার এই বিষয়টি বার্ষিক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল সেই সময়।
সার্কুলার নং 700-11-G-S-48/701/5R-6-48 ;18/03/48 । বিষয়-সমস্ত স্কুল পরিদর্শকদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ – স্কুল অনুমোদনের শর্ত হল রামধুন গান এবং হিন্দিভাষী না হলে অনুদান প্রত্যাহার করা হবে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সর্বজন স্বীকৃত একটি বিষয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে, ওয়ার্ধাতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলন এবং হরিপুরা কংগ্রেসে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিষয়েই অগ্রাধীকার দেওয়া হয়েছিল।
এর পরেও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়া জেলা স্কুলে বাংলা ও হিন্দি দুটি বিভাগ থাকলেও বাংলা বিভাগকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র হিন্দিতেই পঠন পাঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ছাত্ররা |শুরু হয় ছাত্র ধর্মঘট। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত মানভূম জুড়ে বন্ধ্ কর্মসূচীতে ব্যাপক সাড়া ফেলে মানুষের মনে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। বান্দোয়ানের চিরুডি ও বান্দুডাবর গ্রামে হিন্দির কুশীলবরা জনসভা করে ঘোষণা করে যে মানভূমের ভাষা কেবল হিন্দি। মানুষকে লোভ দেখিয়ে বলে হিন্দি ভাষা শিখলে তাকে বা তাদের বাধ, কুয়া, পুকুর এবং টাকা দেওয়া হবে।
বিহার পুলিশ টুসু গায়ক, দশ বছরের অন্ধ বালক বাবুলালকে গ্রেপ্তার করে হাজারিবাগ জেলে নিয়ে যায়। যাবার সময় ওই অন্ধ বাচ্চা ছেলেটিকে মাঝপথে একা একা ছেড়ে দেয়। কতটা অমানবিক হলে এমন কাজ কোন মানুষের ওপর মানুষ করতে পারে!
মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা দেবীকে প্রকাশ্যে বিহার পুলিশ এবং বিহারী গুন্ডারা চুলের মুঠী ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মাটিতে ফেলে চরম মারধোর করে। তারা ভুলে যায় এই মহিলা গান্ধীজীর লবন সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের স্নেহ ভাজন সত্তা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি আদালত থেকে পর্দা চুরি করেছেন।
শবরদের কাছে দেবতার মত মানুষ ছিলেন রেবতী ভট্টাচার্য। তাঁকে পিটিয়ে আধমরা করে বিহার পুলিশ ফেলে যায় জঙ্গলে। লোকসেবক সংঘের সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার না করলে তিনি হয়তো জঙ্গলেই শহিদ হয়ে যেতেন।
বরাবাজার স্কুলে গোলমালের পরে শ্রদ্ধেয় নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তকে বিহার পুলিশ গুম করে রাখে। লোকসেবক সংঘের জনগণ প্রায় চিরুনি তল্লাসী করে তাঁকে উদ্ধার না করলে তাঁকেও হয়তো মেরে ফেলা হতো।
১২ থেকে ১৩ বছরের ছেলে সুধন্য মাহাত ও হরিপদ মাহাতকে বিহারী পুলিশ জরিমানা করে। তারা টুসু সত্যাগ্রহে অংশ নিয়েছিল বলে তাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। বাদ যায়না তাদের বলদ, গরু, মোষ, ঢেকি পর্যন্ত। প্রতিবাদে লেখা হয় টুসু গান।
” সুধন্যার ঢেঁকি
দারোগার বউ
ধানকুটে
সবাই দেখি। “
টুসু সত্যাগ্রহ:
■■■■■■■
মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল টুসু গান, টুসু সত্যাগ্রহ। জননেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ লোকসেবক সংঘের মাধ্যমে মানভূমের বঙ্গভূক্তির জন্য গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন টুসু সত্যাগ্রহের হাতিয়ারকে সামনে রেখে।
লোকসভার সদস্য ভজহরি মাহাত বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক টুসু গানের সৃজন করেছিলেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত টুসু গান –
” শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।
বাঙালি-বিহারী সবাই
এক ভারতের আপন ভাই
বাঙ্গালীকে মারলি তবু
বিষ ছড়ালি- হিন্দী চাই।
বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই
কোন ভেদের কথা নাই
এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে
মাতৃভাষায় রাজ্য চাই।”
মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রগণ্য নেতার নাম অতুলচন্দ্র ঘোষ। তাঁর বড় ছেলে অরুণচন্দ্র ঘোষ। তিনি মানভূম ভাষা আন্দোলনের ওপর বেশ কিছু টুসু গান সৃজন করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গান-
“আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষারে
(ও ভাই )মারবি তোরা কে তারে
এই ভাষাতেই কাজ চলেছে
সাত পুরুষের আমলে ;
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা ব’লে।
এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড
এই ভাষাতেই চেক- কাটা
এই ভাষাতেই দলিল নথি
সাত পুরুষের হক পাটা।
দেশের মানুষ ছাড়িস যদি
ভাষার চির অধিকার।
দেশের শাসন অচল হবে
ঘটবে দেশে অনাচার।”
এই অরুণচন্দ্র ঘোষই অন্য একটি টুসু গানে লেখেন-
“আমার মনের মাধুরী
সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি।
আকাশ জুড়ে বিষ্টি নামে
মেঠো সুরের কোন্ ঢুয়া
বাংলা গানের ছড়া কেটে
আষাঢ় মাসে ধান রুয়া।
-মনের মাধুরী
মনসা গীতে বাংলা গানে
শ্রাবণে জাত-মঙ্গলে
চাঁদ-বেহুলার কাহিনী পাই
চোখের জলে গান ব’লে।
বাংলা গানে করি লো সই
ভাদুপরব ভাদরে
গরবিনীর দোলা সাজাই
ফুলে-পাতায় আগরে।
বাংলা গানে টুসু আমার
মকর দিনের সাক্ রাতে
টুসু ভাসান পরব টাঁড়ে টুসুর গানে মন মাতে।”
সতনপুর গ্রামের (চাষ থানার) জগবন্ধু ভট্টাচার্য হরিদাস ছদ্মনামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে টুসু গান সৃজনে কলম ধরেণ। টুসুর ভেতর দিয়ে বিহারী সরকারের জান্তব ব্যবহারকে তুলে ধরেন। তাঁর লেখা একটি গান-
“প্রাণে আর সহে না
হিন্দী কংগ্রেসীদের ছলনা।
ইংরাজী আমলে যারা গো
করতো মোসাহেবিয়ানা
এখন তারা হিন্দী কংগ্রেস
মানভূমে দেয় যাতনা।”
জগবন্ধু ভট্টাচার্য তাঁর একটি টসু গানে সত্যাগ্রহীদের সাবধান করছেন বিহার সরকারের দমন পীড়নের বিষয়ে এইভাবে-
” মানভূমবাসী থাকবে সতরে
ধলভূমবাসী থাকবে সতরে।
( হিন্দির ) ফন্দী এল জীপগাড়ি ভরে। ধুঃ
যত টাকা কেবল ফাঁকা
বাঁধ কুয়ারই খবরে
( মিথ্যা ) চালান কাটি,নিচ্ছে লুটি
হিন্দী ভাষার প্রচারে।
( তাই ) এদের তরে চাষের অন্ন
দাও এখন বাঁধা দরে
নইলে পরে কেমন করে
মরবি ক্ষুধায় ভাদরে।
সেদিন এরা কেউ ছিল না
থাকবে নাকো এর পরে
( এখন ) এত ব্যথা গোপন কথা
( শুনায় )কমিশন ডরে।”
আদ্যন্ত গান্ধীবাদী কাননবিহারী ঠাকুর টুসু সত্যাগ্রহকে সমর্থন করে লেখেন-
” স্বাধীন জীবনে
এবার মিলব রে জনে জনে। রং
সত্য পথে চল্ রে সবাই
গান্ধী-বাণী রাখ্ মনে।
কানন বলে পাবি আরাম
বাংলা ভাষার জীবনে।”
মধুসূদন মাহাত থাকতেন বাঁশাবুরু। তিনি টুসু গান বাঁধলেন-
” মন মানে না হিন্দীরে সইতে।
ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।
মাতৃভাষা হরে যদি
আর কি মোদের থাকে রে।
( তাই ) মধু বলে মাতৃভাষায়
ধ্বজা হবে বহিতে।”
আবার “বাংলা লোকসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপাদান” গ্রন্থে ড.রবীন্দ্রনাথ শাসমল একটি টুসু গানের সন্ধান দিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে-
” পাটনা বিহীর আইন সভায়
হিন্দী ভাষীর দল ভারী
( তাই )ভোটের জোরে ভাঙছে তারা
লোকসেবকের কলগাড়ী।
আইন সভায় হিন্দী ভাষার
হুকুমদারী চালাতে
বাংলা ভাষা করছে দমন
মানভূমের জ্বালাতে।
মাতৃভাষায় প্রদেশ গঠন
গোটা দেশের নীতিরে
( পাছে ) এই নীতিতে জেলা হারায়
বিহারের এই ভীতিরে।
মানভূমেরই মাতৃভাষা
বাংলা ভাষা চারধারে।
সেই কারণে বাংলা দমন
চালায় বিহার সরকারে।
হোক না যতই পীড়ন দমন
হিন্দী রাজের অত্যাচারে
লোকসেবকের অটল গাড়ী
টলবে নাকো কোনো ধার।
ভাষার নীতি করতে বিচার
কমিশনে ভার দিল
হিন্দী রাজের মাথায় এবার
বিষম বিপদ পড়িল।
বাংলা বিহার মামলা দায়ের
ভাষা ভিত্তিক স্টেশনে
জনমতের বাজবে বিগুল
বিচারের কমিশনে।
চলল এবার ইঞ্জিন ঐ
পুরু আছে কয়লাজল।
( এবার ) মিথ্যাচারীর টলবে আসন
মিথ্যা হবেরে বিকল।
ভাষা নীতির টিকিট আছে
যাবিরে আজ কোন খানে।
হওরে এবার জংশন পার
লোকসেবকের ইঞ্জিনে।”
নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত:
■■■■■■■■■
মানভূমের স্বাধীনতার ইতিহাসে নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তকে বলা হয় মানভূমের গান্ধী। অসহযোগ আন্দোলন, শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশবোধে উদ্বুদ্ধ করার সার্থক চেষ্টা এবং যার জন্য মহাত্মা গান্ধী এই আশ্রমের নাম দেন নিবারণ আশ্রম, দেশবন্ধু প্রেস স্থাপন, মুক্তি ( ২১/১২/১৯২৫) পত্রিকা প্রকাশ এবং স্বদেশবোধের লেখা ছাপানো, সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে একাধিকবার জেলে যাওয়া-আর এই সমস্ত কিছু নিয়েই তিনি মানভূমের গান্ধী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত।
অতুলচন্দ্র ঘোষ:
■■■■■■■
মানভূমের স্বাধীনতার ইতিহাসে ঠিক এভাবেই স্মরণ করা হয় আর একটি নাম – “মানভূমকেশরী” অতুলচন্দ্র ঘোষ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বি.এ পাশ করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে পুরুলিয়া কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিবাহ করেন মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা দেবীকে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল সময়ে কোর্টের কাজ q যোগ দেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন,লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মানভূম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হন। তখন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত। নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের মৃত্যুর পরে তিনি১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মানভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হন। তখন সম্পাদক হন বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯২১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত বহুবার কারা বরণ করেছেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেপ্তার হন নিরাপত্তা আইনে।
উল্লেখ করা যায় তিনিই ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় তিন হাজার পঞ্চায়েত গঠন করেণ মানভূমে। কিন্তু ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিহার সরকার বাংলা ভাষা এবং বাঙালি দমনের যে জান্তব অধ্যায় শুরু করে,বার বার কংগ্রেসের রাজ্য ও জাতীয় স্তরে বলেও কিছু হয় না, বাধ্য হয়েই তিনি কংগ্রেস ছেড়ে গঠন করেণ নতুন দল “লোকসেবক সংঘ”। টুসু সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেণ তিনি। এই আন্দোলনকে সামনে রেখে যে সমস্ত টুসু গান লেখা হয়েছিল সেই গানগুলি সংকলিত করে ” টুসুগানে মানভূম “নাম দিয়ে প্রকাশ করেণ তাঁর পুত্র অরুণচন্দ্র ঘোষ।
কে.বি.সহায়ের অপচেষ্টা:
■■■■■■■■■■■
বিহারের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী তথা সেই সময়ের রাজস্ব মন্ত্রী কে.বি সহায় ঘোষণা করেণ – লোকসেবক সংঘ সদর মানভূমকে পশ্চিমবাংলায় নিয়ে যাবার যে রাজনৈতিক টুসু আন্দোলন করছেন তা বিপদ জনক। তার উদ্দেশ্য বিহার সরকারের নিন্দা করা। হিন্দি ভাষীদের গাল দেওয়া। প্রসঙ্গত বলা যায় তিনি ইংরাজি তর্জমা করেন ভজহরি মাহাতর লেখা –
“শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি
ডঙ্গ দেখাই |”
এর অনুবাদ করেন -HEAR BIHAREE BROTHERS ,YOU CANNOT KEEP US WITH BIHER BY SHOW OF LATHI (FORCE).
জগবন্ধু ভট্টাচার্যের একটি গানকে অনুবাদ করা হয় এইভাবে-
“প্রাণ আর সহেনা
হিন্দী কংগ্রেসীদের ছলনা |”
অনুবাদ-
OUR SOULS CAN NO LONGER BEAR THE TRICKS OF THE HINDI SPEAKING CONGRESSMAN.
বিহারের অত্যাচার:
■■■■■■■■■
এবার বিহার সরকার টুসু সত্যাগ্রহীদের দমনের জন্য১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের মধ্যে বিহারের জন নিরাপত্তা আইনের ৯ ( ৫ ) ধারায় পাঁচটি দলে ১৭ জন টুসু সত্যাগ্রহীকে এবং ভারতীয় দন্ডবিধির ১৪৩ (বে-আইনি জনতা), ২২৫(সরকারি হেফাজত থেকে আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা) এবং ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধা দান) ধারায় লোকসেবক সংঘের অতুলচন্দ্র ঘোষ, সাংসদ ভজহরি মাহাত, লাবন্যপ্রভা দেবী, অরুণচন্দ্র ঘোষ, সাংবাদিক অশোক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে।
সে সময় অতুলচন্দ্র ঘোষ ৭৩ বছরের বৃদ্ধ। ব্রঙ্কাইটিসের রুগী। নিন্ম রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভুগছেন। তাঁকে তৃতীয় শ্রেনির বন্দিদের মতই খোলা ট্রাকে করে জেলে নিয়ে যাওয়া হল। পরে ঐ খোলা ট্রাকেই পুরুলিয়া জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হল হাজারিবাগ জেলে। পুরুলিয়া থেকে যার দূরত্ব ১৩৫ মাইল।
ভজহরি মাহাত ছিলেন সাংসদ। তাঁকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আদালত তাঁদের এগারো মাসের কারাদন্ডের সাজা দিল।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা ঘোষকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর.বি.সিং একমাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দিল। ১০০ টাকা জরিমানা। অনাদায়ে একমাস বিনাশ্রমে জেল।
৮ মার্চ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের “মুক্তি”পত্রিকা জানাচ্ছে টুসু সত্যাগ্রহীদের আরও পাঁচটি দলের ২৩ জনকে কারাদন্ড, লাবন্যপ্রভা দেবীর আরো এক দফা কারাদন্ড এবং জরিমানা, হেমচন্দ্র মাহাতর আরও দুই দফা কারাদন্ড ও জরিমানা, এম. পি ভজহরি মাহাতর আরো এক দফায় এক বছরের কারাদন্ড ও একহাজার টাকা জরিমানা, এম.এল.এ সমরেন্দ্র ওঝার এক বছরের কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা। অন্ধ বালক বাবুলাল মাহাতর কারাদন্ড ও দুশো টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদন্ডর আদেশ জারি হল।
অরুণচন্দ্র ঘোষ সহ আরে চারজনের চোদ্দ মাস জেল, সাংবাদিক অশোক চৌধুরী, রামচন্দ্র অধিকারীকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো তিনমাস বিনাশ্রমে কারাদন্ড। বিহার বিধানসভার এম.এল.এ শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জীর এক বছরের কারাদন্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা হল।
বান্দোয়ার থানার মধুপুর গ্রামের কুশধ্বজ মাহাতর নাবালক পুত্র সুধন্ধা মাহাতর নয় মাস কারাদন্ড। এক হাজার টাকার জরিমানা। অনাদায়ে তিন মাস সশ্রম কারাদন্ড হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি তার বাড়ির সমস্ত কিছু ক্রোক করে নেয় পুলিশ।
২ মার্চ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে হবিবুল্লা নামের সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে গিয়ে মানবাজার থানার পিটিদারি গ্রামে টুসু সত্যাগ্রহীদের জরিমানা আদায়ের নামে বাড়ির তালা ভেঙে সম্পত্তি ক্রোক করে, মহিলাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
১৬ মার্চ ১৯৫৪ নয় মাস কারাদন্ডে দন্ডিত অতুলচন্দ্র ঘোষকে দেড়মাস কারাভোগের পর হাজারিবাগ জেল থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী লাবন্যপ্রভা ঘোষ, ভাবিনী মাহাতকে পুরুলিয়া জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় হাজারিবাগ জেলে। শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জী, সমরেন্দ্র ওঝা সহ একুশ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় হাজারিবাগ জেলে।
বিহার সরকার হিন্দি ভাষা প্রচারের জন্য তিরিশ লক্ষ টাকা অনুদান দেন তখন। সেই টাকা পা চাটা নেতারাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেন।
লোকসভায় মানভূম নিয়ে এন.সি.চ্যাটার্জী:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
২৯ মার্চ,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। লোকসভাতে শিক্ষাখাতে দাবি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় এন. সি.চ্যাটার্জী মানভূমের টুসু সত্যাগ্রহীদের ওপর বিহার সরকারের দমন পীড়নের বিষয়টিতে প্রতিবাদ করেন। তিনি আবেদন করেন ১৯৩১ এর জনগণনা অনুসারে মানভূম সদর মহকুমায় শতকরা ৮৭ জন মানুষ বাংলা ভাষী। বাংলা ভাষার ওপর সেখানে দমন পীড়ন চলছে।
বিহার বাংলা সংযুক্তির অপচেষ্টা:
■■■■■■■■■■■■■■
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই পাটনাতে একটি বিশেষ সভায় বিহারের সি.এম শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, বিহারের শিক্ষা সচীব বদ্রীনাথ শর্মা, রাজস্ব সচীব কৃষ্ণবল্লভ সহায়, তথ্য সচিব মহেশপ্রসাদ সিংহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অতুল্য ঘোষ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কূট চালের শিকার হয়ে যান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
বিধানচন্দ্র রায় সাংবাদিক সম্মেলনে জানান-
প্রথমত – বিহারে বাংলা ভাষার নিরাপত্তার জন্য বিহার সরকার চেষ্টা করছে।
দ্বিতীয়ত- খুব তারাতারি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তৃতীয়ত- শোনা গেছিল বিহারে বাংলা ভাষার অনুশীলনের অনেক অভিযোগ। কিন্তু বিহারে ছাত্রদের বাংলা ভাষা অনুশীলনে কোন বাধা নেই।
চতুর্থত- বিহার সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ গুলি সম্পূর্ন ভিত্তিহীণ।
পঞ্চমত- অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে তদন্ত দরকার। বিহার সরকার খুব তারাতারি তার উত্তর দেবে।
বিনোদানন্দ ঝাঁ এর মিথ্যাচার:
■■■■■■■■■■■■■
কিন্তু ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই কংগ্রেস নেতা বিনোদানন্দ ঝাঁ পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে বান্দোয়ান কল্যান সমিতির সভাতে বিহার সরকারের হয়ে বলেন- “মানভূম বঙ্গাল মে নহী জায়েঙ্গে, জানে পর খুন কে নদী বহা দেঙ্গে”। “মানবাজারে পোস্টার লেখা হয় “মানবাজারবাসী বোল রহী বিহার মে রহেঙ্গে |”
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন:
■■■■■■■■■■
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ খিস্টাব্দে মাদ্রাজের কুর্ণুলে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফজল আলি বলেন- এই কমিশন সুবিচার দেবার চেষ্টা করবে। কমিশনের কাছে যে সমস্ত অভিযোগ জমা হবে তা সত্যতার সাথেই বিবেচনা করা হবে।
পোত্তি শ্রীরামালুর আত্ম ত্যাগ:
■■■■■■■■■■■■
উল্লেখ্য তেলেগু ভাষীদের দাবী মতই লোকসভাতে বিল আসে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট, এবং অক্টোবরে গঠিত হয় অন্ধ্রপ্রদেশ। মাদ্রাজে তেলেগু ভাষীদের জন্য পৃথক রাজ্য গঠনের আন্দোলন চলছিলো। আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহী পোত্তি শ্রীরামালু। এই স্বাধীনতা সংগ্রামী তেলেগু ভাষীদের পৃথক রাজ্য গঠনের দাবীতে অনশণ করে ৫৮ দিনের মাথায় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ হন এই মৃত্যু ভারতের অন্যান্য ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি দেয় সে সময়।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনে আর্জি:
■■■■■■■■■■■■■■
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কেন্দ্র সরকার গঠন করে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। এর নাম দেওয়া হয় S.R.C(STATES REORGANISATION COMMISSION) ।
এই কমিশনের সদস্য হন এইচ .এন খাঙ্গুরু, কে.এম.পানিক্কর। চেয়ারম্যন হন সৈয়দ ফজল আলি।
উল্লেখ করা যায় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে পুরুলিয়া বার অ্যাসোসিয়েশন সহ বেশ কিছু সংগঠন স্মারক লিপি দিয়ে বলে মানভূম ও ধলভূমকে কিভাবে অন্যায় করে বিহারের সাথে যোগ করা হয়েছিল।
দাবী করা হয় সমস্ত মানভূম জেলা, সিংভূম জেলার ধলভূম মহকুমা বাংলা সংলগ্ন ৫,৩০০ বর্গমাইল জুড়ে যে বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষা বহমান তাকে বাংলার সাথে যুক্ত করা হোক। এখানে বলা হয় বিহার সরকার কিভাবে বঙালিদের ওপর অত্যাচার করছে সে কথাও।
“সংগঠন” পত্রিকার সম্পাদক স্বামী অসীমানন্দ, যিনি বিপ্লবী অন্নদাকুমার চক্রবর্তী, তিনি হিন্দি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কলম ধরলেন।
বিহারের অপচেষ্টা:
■■■■■■■■■■
২৩ আগস্ট ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ, “মুক্তি” পত্রিকায় লেখা হয় বিহার সরকারের মন্ত্রী মানভূমের নানা গ্রামে গিয়ে মানুষকে কিভাবে ভুল বোঝাচ্ছে। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয় বিহারে থাকতে চাইছে লেখা স্মাকরলিপিতে কিভাবে জাল সই সংগ্রহ করছে বিহার সরকার।
লোকসভাতে মানভূম প্রসঙ্গে সুচেতা কৃপালনী ও এন.সি.চ্যাটার্জী:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে লোকসভাতে সাংসদ সুচেতা কৃপালনী এবং সাংসদ এন.সি চ্যাটার্জী জানালেন বিহার সরকার কিভাবে অন্যায় আচরণ, অমানবিক আচরণ করছে মানভূমের মানুষের ওপর। এই আচরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
সাংসদ চৈতন্য মাঝির সংসদে ভাষণ:
■■■■■■■■■■■■■■■■
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর লোকসভায় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সিদ্ধান্ত বিষয়ে সাংসদ চৈতন্য মাঝি ভাষণ দেন। তিনি বলেন –
“আমরা বিহারের বাংলাভাষা অঞ্চলগুলি চেয়েছি। সেই সকল অঞ্চলে আদিবাসীদের নিজস্ব কোন ভাষা নেই। তাঁরা একমাত্র বাংলাতেই কথা বলেন। যেমন ভূমিজ, দেশওয়ালি মাঝি, কড়া, মুদি মাহলি ইত্যাদি। এবং প্রকৃতপক্ষে সাঁওতালরাই নিজেদের একমাত্র আদিবাসী বুলি বলেন এবং তার সঙ্গে বাংলা বলেন-যা তাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা।
সাঁওতালরা বিহারে সংখ্যায় ১৭ লক্ষ। তাদের অধিকাংশ এইসব বাংলাভাষী অঞ্চলে বাস করে। যদি এই সমস্ত অঞ্চল বাংলায় যুক্ত হয়,তবে এই সকল অঞ্চলের ১২ লক্ষ সাঁওতাল বাংলার সাড়ে ছয় লক্ষ সাঁওতালের সঙ্গে যুক্ত হবে।
বিহার সরকার দাবি করেছেন যে, আদিবাসীদের সামাজিক জীবনের সম্বন্ধ বিহারের সঙ্গে। সে-কথা ভিত্তিহীন। আমাদের সমস্ত সামাজিক সম্বন্ধ পশ্চিম বাংলার সঙ্গে। আমাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জীবন বাংলার সংস্কৃতি অনুযায়ী”। (এই বক্তৃতার অংশটি ছাপা হয় ২ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের “মুক্তি” পত্রিকায়)।
সাঁওতালরা ১৭ লক্ষ বিহারে থাকে। তারা বাংলা বলে। বাংলার সাথে সাঁওতালদের এই অঞ্চল যুক্ত হলে এক বিরাট জনজাতির অঞ্চল বাংলায় আসবে। কিন্তু বিহার সরকার দাবি করে সাঁওতালদের সাথে তাদের যোগই বেশি। কিন্তু সাঁওতালরা বলে বাংলার সাথেই তাদের সাংস্কৃতিক যোগ।
আদালতের বিচার:
■■■■■■■■■■
টুসু সত্যাগ্রহ প্রসঙ্গে “মুক্তি” পত্রিকা ধারাবাহিক কলাম প্রকাশ করে যাচ্ছিল। ২ জানুয়ারি ১৯৫৬ তে সেখানে লেখা হয় পুরুলিয়ার জজ কোর্টে টুসু সত্যাগ্রহীদের ১ম দফার রায়ে বলা হয় টুসু সত্যাগ্রহীদের ১৮ টি আপীল জজ কোর্টে দায়ের করা হয়। ১৬ টি আপীলের ৪৩ জন সত্যাগ্রহীদের সম্বন্ধে রায় দেওয়া হয়।
নিন্ম আদালতে বি. এম. পি .ও ( বিহার মেনটেনেন্স অব পাবলিক অর্ডার ) এ্যাক্টের ৯ (৫) ধারায় ৪৩ জনের ছয় মাস থেকে এক বছর কারাদন্ড পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড বা বিনাশ্রমে কারাদন্ড এবং দুশো থেকে এক হাজার পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে এক মাস থেকে তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ডের আদেশ হয়। আবার কিছু সত্যাগ্রহীর বেলায় ঐ একই ৯(৫) ধারায় ২ দফা থেকে ৫ দফা পৃথক পৃথক সাজা হয়। এই সত্যাগ্রহীদের মধ্যে একজন ছিল অন্ধ বালক ও দুইজন মহিলা। একজন রাঘব চর্মকার এরই মধ্যে মারা গেছিলেন।
এই আপীলের রায়ে অশোক চৌধুরী ও অরবিন্দ ওঝাকে বেকসুর খালাস করা হয়। আরও চারজন সত্যাগ্রহীকে যাদের বিরুদ্ধে ঐ একই ৯(৫)ধারায় ৩মাস থেকে ৫ দফায় সাজা হয়েছিল তাদের দু একটি দফায় খালাস দিয়ে বাকী দফায় সাজা দেওয়া হয়।
অন্ধ বালক বাবুলাল মাহাতকে দুই দফায় মোট ৩ মাস বিনাশ্রমে কারাদন্ড এবং ২০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৪ সপ্তাহ কারাদন্ড দেওয়া হয়। বাবুলাল এরই ভেতর আট মাস জেল খেটে বের হয়।
আপীলের সবাই নিন্ম কোর্টের দন্ড কমিয়ে ২ মাস সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিন থেকে এক মাস কারাদন্ডের আদেশ বহাল রাখা হয়েছিল।
আপীলগুলি দায়ের করার প্রায় দুই বছর বাদে মাত্র ১৬ টি মামলার রায় প্রকাশ পেল। এর ভেতর প্রায় সত্যাগ্রহীরা ৬ মাস থেকে ১ বছর জেল খেটে বের হয়ে গেছিল। কেউ কেউ ২১ মাস অবধী জেল খেটেছিল। জরিমানা আদায় করতে মনুষত্যহীণ আচরণ বহু ক্ষেত্রে করা হয়েছিল।
আসামী পক্ষের উকিল জ্যোতির্ময় দাশগুপ্ত অ্যাডিসনাল জজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন – সম্প্রতি বাংলায় যাব না, বলে পুরুলিয়াতে যে তথাকথিত সত্যাগ্রহের অভিনয় করান হল, তাতে ঐ একই বি.এম.পি.ও -র ৯(৫) ধারায় একই ম্যাজিস্ট্রেট তথাকথিত আসামীদের আদালতে ওঠা পর্যন্ত সাজা দেওয়াই পর্যাপ্ত মনে করেছেন। অথচ এদিকে টুসু-সত্যাগ্রহীদের ঐ একই ধারায় এক বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাস সশ্রম কারাদন্ডর আদেশ দেওয়াকেও পর্যাপ্ত মনে করলেন না।
তখন অ্যাডিসনাল জজ জানান বিচার ম্যাজিস্ট্রেটের অভিরুচি।
আপীলের বিচারে এক দফায় অটল মাহাত এবং হেম মাহাতকে রেহাই দিয়ে অ্যাডিসনাল জজ বলেন রেহাই দেওয়া হল। কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে আবার নতুন মোকদ্দমা আনতে পারেন।
উকিল জ্যোতির্ময় দাশগুপ্ত, জগদীশ চ্যাটার্জী, সতীশচন্দ্র সাহা, প্রমোদকুমার ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, হরকালী মুখার্জীরা আসামীপক্ষের হয়ে সমর্থন করেন।
বিহারের জনসমর্থন আদায়ের মিথ্যাচার:
■■■■■■■■■■■■■■■■■
এবার বিহার সরকার নতুন চাল দিল। পুরুলিয়াকে বঙ্গভূক্তির বিরুদ্ধে জনমত সমর্থনের চেষ্টাতে হরতালের ডাক দিল। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি “মুক্তি” পত্রিকা থেকে জানা যায় এই হরতাল ব্যর্থ হয়েছিল। এবার পুলিশ পুরুলিয়ার সমস্ত বাস সার্ভিস বন্ধ করে দিল। গুন্ডা দিয়ে জনগণকে ভয় দেখাতে শুরু করলো। গুন্ডারা ঝালদা এবং চান্ডিলে বাঙালিদের সম্পত্তি লুঠ করলো। এই পরিস্থিতিতে অতুলচন্দ্র ঘোষ টেলিগ্রাম করে ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহেরুকে সমস্ত জানালেন।
সার্বিক হরতাল ও অরন্ধন:
■■■■■■■■■■■■
বাংলাভাষী অঞ্চলের দাবীতে এবং কেন্দ্র সরকাারের আচরণের প্রতিবাদে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি পুরুলিয়ায় হরতাল পালন করলো লোকসেবক সংঘ। পালিত হল সমস্ত বাড়িতে অরন্ধন। শহরের রাসমেলা ময়দানে হল বিরাট জনসভা। পরিচালনা করলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ।
এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানালেন -পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারকে একত্র করে “পূর্বপ্রদেশ” নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হবে। বাংলার প্রবীন কংগ্রেসের নেতারা বিষয়টি মানতে চাইলো না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে জনসভা:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
বিধান চন্দ্র রায়ের “পূর্বপ্রদেশ” গঠনের ঘোষণার পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে প্রতিবাদী সম্মেলন হল। সেই সম্মেলনে বক্তৃতা করলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, জননেতা জ্যোতি বসু, লেখক গোপাল হালদার, কাজী আবদুল ওদুদরা।
টুসু সত্যাগ্রহের লং-মার্চ:
■■■■■■■■■■■
জামতারা গ্রামে ভাষা রক্ষার দাবিতে দশ হাজার মানুষ জড়ো হল। লোক সেবক সংঘের জেলা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বাংলা জুড়ে সত্যাগ্রহ পালিত হবে।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ। ২০ এপ্রিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি স্বর্ণময় দিন। দিনটা শুক্রবার। পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানা থেকে পাকবিড়র্যা গ্রামের থেকে শুরু হল ঐতিহাসিক পদযাত্রা। বঙ্গ সত্যাগ্রহ আন্দোলন। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবন্যপ্রভা দেবীর নেতৃত্বে ১,০০৫ জন মানুষ পায়ে হেঁটে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে চললো মিছিল। সবার হাতে সাদা রঙের ওপর সূর্য ও চরকা আঁকা পতাকা।
বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাত, চৈতন্য মাঝি, অরুণচন্দ্র ঘোষের পরিচালনায় গাইতে গাইতে চললো টুসু সত্যাগ্রহের দল। গাইলো রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান।
মিছিল যত এগিয়েছে দুধারে দাঁড়ানো মানুষ শাঁখ বাজিয়ে, মঙ্গল ধ্বনি করে, খাদ্য দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে সত্যাগ্রহীদের।
টানা ১৬ দিন ধরে এগিয়ে চলে মিছিল। বাঁকুড়া, বেলতোড়, সোনামুখি, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান, রসুলপুর, মেমারি, পান্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, গোঁদলপাড়া, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, হাওড়া পেরিয়ে ৬ মে ১৯৫৬ র বিকেলবেলায় কলকাতা ময়দানে পৌঁছয়। ময়দানে হয় জনসভা।
৭ মে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ডালহৌসি স্কয়ারে ১৪৪ ধারা ভাঙেন। সত্যাগ্রহীদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর জেল, আলিপুর স্পেশাল জেলে।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকেন বিধান চন্দ্র রায়। বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
লোকসভায় বাংলা বিহার হস্তান্তর বিল পাশ:
■■■■■■■■■■■■■■■■■■■
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট লোকসভাতে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর বিল পাশ হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরুলিয়া সদরের ১৬ টি থানা এবং পূর্ণিয়ার কিছুটা ১ নভেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
থানা গুলি হল-
(১)ঝালদা : আয়তন ২২০বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১১৫৩৯৫ জন।
(২) জয়পুর: ৮৯ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪৩৭৬৪ জন।
(৩) পুরুলিয়া: ২১৬ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১৫৬০২৪ জন।
(৪) বলরামপুর: ১০৩ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৫১৬৯ জন।
(৫) হুড়া: ১৫২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৬২৬১২ জন।
(৬) আড়শা: ১০২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৭৩০২ জন।
(৭) পুঞ্চা: ২০১ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৫৭৫৪ জন।
(৮) বাঘমুন্ডি: ১৭২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫১১৮৪ জন।
(৯) বরাবাজার: ১৬০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৭৬৯৩৯ জন।
(১০) বান্দোয়ান: ১৪২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪০০৭৬ জন।
(১১) মানবাজার: ২৫৭ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১২০৬৯৯ জন।
(১২) রঘুনাথপুর: ১৫১ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১০৫৮১২ জন।
(১৩) সাঁতুড়ি: ৭০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৩৩৭৫১ জন।
(১৪) নিতুরিয়া: ৮০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪৬৫৯০ জন।
(১৫) কাশীপুর: ১৭৩ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৭৯৭৫২ জন।
(১৬) পাড়া: ১১৯ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৬৮৩০১ জন।
মোট ১৬ টি থানা। যার আয়তন মোট ২৪০৭ বর্গমাইল। মোট লোকসংখ্যা ১১৬৯০৯৭ জন।
এই অঞ্চলের বাইরে ছিল জাতীয় সড়কের পূর্বভাগ -এর কিষাণগঞ্জ মহকুমা এবং গোপালপুর অঞ্চলের ৬০০ বর্গমাইলের মত অঞ্চল।
এলো বিজয়ের দিন:
■■■■■■■■■
অবশেষে এলো সেই পুন্য দিন |১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর |বাংলা ভাষার উপর হিন্দী সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লড়াই-এর বিজয় দিন।
এই দিনকে স্মরণ করে কবি নরেন্দ্র দেব এবং কবিপত্নী রাধারাণী দেবী লিখলেন-
সুস্বাগতম
●●●●●●●●●●●
” বহু মানে আজ মানভূমে মোরা
এই শুভদিন নিলাম বরি’ ,
ধন্য হলেন জননী আবার
হারানো তনয় বক্ষে ধরি |
জয়গৌরবে এসেছে ফিরিয়া
সন্তান তার আপন গেহে ,
ছিন্ন অঙ্গ দেশমাতৃকা
দেখা দিল পুনঃ পূর্ণদেহে |
জানি, জানি যাহা রয়ে গেল বাকি
মাতৃভাষায় ঐক্যতীরে
তোমাদের দৃঢ় সাধনার বলে
একদা তাহাও আসিবে ফিরে |
( “মুক্তি”পত্রিকায় প্রকাশিত/১৭শ বর্ষ/৪০ সংখ্যা/সম্পাদক-বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত )
মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারীরা:
■■■■■■■■■■■■■■■
মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল নারী শক্তি। মানভূম ,ধলভূমের আদিবাসী মেয়েরা থেকে শুরু করে লাবন্যপ্রভা দেবী, বাসন্তী দাশগুপ্ত(রায়), চাষির ঘরের মেয়ে ভাবিনী মাহাত, দধীরাম দাশগুপ্তের দুই মেয়ে- ডালু ও মনোরমা, পাঞ্চী সর্দারের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে ১৯৩১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চারবার জেল খেটেছেন লাবন্যপ্রভা দেবী, তখন তাঁর ঘরে চারটি ছোট্ট বাচ্চা। ভাষা আন্দোলনের মিছিলে কলকাতায় এসে আইন অমান্য করলে বিধান রায়ের সরকার তাঁকে এগারো দিন জেলে রাখে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জরুরী অবস্থার সময় কলম ধরে সরকারের সমালোচনা করেও গ্রেপ্তার হন তিনি। আর এই কারণেই তাঁকে ডাকা হয় মানভূম-জননী নামে।
ভাষা বিজয় কি প্রাপ্য সম্মান পেল?
■■■■■■■■■■■■■■■■■
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত চলেছিল মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন। মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন হলেও এর মূলটা ছিল নিহিত ভাষার বিভাজনে। আন্দোলনের সূত্রপাত এবং সংগঠনের মূলে ছিলো ভাষার আন্দোলন।
বাংলাদেশের ভাষার আন্দোলন যে চেতনার বীজ রোপন করেছিল মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটেছিল।
পক্ষান্তরে মানভূমের ভাষার আন্দোলনের পরিণতিতে মানভূমের পূর্বাংশকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যে সমাপ্ত হয়। মানভূমের ভাষার লড়াইয়ে কাউকে হয়তো প্রাণ দিতে হয়নি। তবে নয় বছর ধরে চলা আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষকে নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। মানভূমের বাংলা ভাষার জন্য লড়াই শুধু মাত্র মানভূমবাসীর গৌরব নয়, এ গৌরব পৃথিবীর সমস্ত বাঙালির।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আন্দোলনের ইতিহাস আজ মানুষ প্রায় ভুলে গেছে। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাকবিড়াতে ভাষা স্মারক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবের মুখ দেখেনি।স
মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে সরকারী বা বেসরকারী বিজয় উৎসব প্রায় হয়না।
পুরুলিয়ার সিধু-কানহু-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে যদিও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ্য হয়েছ। কিন্তু এই ইতিহাস বাংলার সামগ্রিক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যলয়ে পাঠ্য হওয়া উচিত।
বারে বারে আক্রমন বাংলা ভাষাকেই:
■■■■■■■■■■■■■■■■■
বাংলাই মনে হয় সেই ভাষা বা একমাত্র ভাষা যে ভাষার অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হয়েছে অখন্ড বাংলার পশ্চিম সীমান্তের মানভূম থেকে পূর্ব সীমান্তের বরাক পর্যন্ত।
বাঙালিকে অত্যাচার ,নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর। পৃথিবীর আর কোন ভাষার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।
আজকে আসামে এন.আর.সি-র নাম করে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাগরীকত্বের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল, তার সিংহ ভাগই বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষীক মানুষকে এন.আর.সি-র ভয় দেখাচ্ছে হিন্দী সন্ত্রাসবাদীরা। ত্রিপুরা, মেঘালয়, ঝাড়খন্ডের বাঙালিরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আর সেই জন্যই প্রতি বছর ১ নভেম্বর বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির ভাষাকে নিয়ে শপথ নেবার পুন্য একটি দিন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯ মে , ১ নভেম্বর বাঙালির ভাষা নিয়ে তিনটি তারিখ শুধু নয়। তিনটি জাগরণের দিন। জেগে ওঠার দিন।
তথ্য ঋণ্:
■■■■■■
(১) BENGAL DISTRICT GAZETTERERS -MANBHUM. H COUPLAND,BENGAL SECRETARIAL BOOK DEPOT,1911
(২) টুসুর গানে মানভূম/সম্পাদনা-অরুণচন্দ্র ঘোষ।
(৩)ভাষা স্মারক অর্ধ -সমাপ্তই, অবহেলায় ছড়াচ্ছে ক্ষোভ/সমীর দত্ত/আনন্দবাজার /২০১৫ ।
(৪) ভাষা আন্দোলন দেশে দেশে/উত্তম কুমার রায়/ পরিবর্তন/ ২০১৭ ।
(৫) টুসু/ড. শান্তি সিংহ /লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ /পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
( ৬ ) কোরক সাহিত্য পত্রিকা/বাংলা ভাষা সংখ্যা/শারদীয়া ১৪১০ ।
( ৭ ) পশ্চিমবঙ্গ /পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা/জুন২০০৭ ।
( ৮ ) রক্তে- ভাষা মাতৃভাষা /সম্পাদনা -নির্মলেন্দু শাখারু এবং জীবনকুমার সরকার/রিডার্স সার্ভিস/৫৯/৫ এ, গড়ফা মেন রোড/কলকাতা – ৭০০০৭৫ ।
( ৯ ) বাংলা লোকসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপাদান/ ড. রবীন্দ্রনাথ শাসমল/ইউনাইটেড বুক এজেন্সি/টি-৩১ / বি, কলেজ রো /কলকাতা-৭০০০০৯ ।
( ১০ ) অনৃজু/মানভূম লোকসংস্কৃতির মুখপত্র/২৫ তম বর্ষ/শারদ সংখ্যা/১৪১৭ বঙ্গাব্দ ।
●●●●●●●●●●
গুচ্ছ কবিতা:
বিকাশ চন্দ
~~~~~~~~~~~~~~~~
অচেনা দুঃখের আর্তনাদ
———————————-
অতটা জীর্ণ নয় অক্ষর মালা যতটা হাড় জিরজিরে আমি,
তবুও অক্ষরগুলি হাতে এলে কেমন প্রতিমা হয়ে যায়—
এ ভাবেই রাতগুলো অন্ধকার টেনে আনে চোখে,
দেখতে পাই অক্ষরগুলো জোনাকি চন্দ্রাতপ—-
কাছে দূরে অনেকেই ঘিরে ধরে ফুলের নরম পাঁপড়ি।
দীর্ঘশ্বাস নিলে ঘ্রাণে আসে নতুন ধানের গন্ধ হেমন্ত হাওয়া
কিছু চেনা অচেনা সুগন্ধী ফুলেদের বন বাতাসী খেলা,
সকল বদলের গর্হিত চিহ্ন বোঝে গাছের শরীর —
মানুষতো উন্মোচিত প্রগাঢ় কেতাদুরস্ত বিষয় বাসনা বোধে
শ্রীময়ী সংকেতে কত ভাষালাপ নিষিদ্ধ সময়ে বাতাসে ভাসে।
দেশান্তরি মানুষের মতো পাখিদের ও ভাষা আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে
কিছু ভাষা ভেসে আসে ভেজা দৃষ্টি পথে চোখের পাঁপড়ি ফুলে,
বন জানে সমস্ত বসন্ত কথা কৃষি ভূমি নীরব উর্বরা শিকড়ের টান—
অচেনা উচ্চারণে ভেসে আছে রাতের নক্ষত্র দিনে ফুলে মৌমাছি গান,
নিঃশব্দে মানুষের ভেতর জমে থাকে তবু অচেনা দুঃখের আর্তনাদ।
ভাষা অভিমান
——————–
অক্ষর শব্দ বর্ণমালা বোঝে না স্বাধীনতা
তবুও বুঝে ছিল মুক্তপ্রাণ দোয়েল পাখির ডাক
মোটা ভাত কাপড় আর নিজস্ব ভাষা
মুক্ত মন মানেতো অনুক্ত অধিকার কথা
সমস্ত জলের রঙ স্বাদ এক
দেশ কাল মাটি গড়ে ভাষার শরীর
এখন বিমুক্ত পদ্মা মেঘনা গঙ্গার টানে
সীমা রেখা বার বার সীমান্তে ডাকে
শাপলা শালুক জানে বুকের শব্দ মালা
অক্ষর হৃদয় খুঁড়ে বারবার ফিরে আসে
একুশে ফেব্রুয়ারি আর ঊনিশে মে।
মুক্তমনা ব্লগার এসব জানে তবু মৃত্যু ডাকে
কোথাও কি দ্বন্দ্ব আছে অন্ধ রাতের ভেতর
আমার ভাষার অন্তর্গত প্রাণের সংলাপ
ধর্মান্ধ কুয়াশা এখন সীমান্ত পারাপার
হায় ভাষা সংগ্রাম নিজস্ব চেতনা বিলাপ
স্বাধীনতা বোঝেনি গোপন মৃত্যু
দুয়ারে আঁচল ছড়িয়ে দুয়ার আগলে মা
বাছারা ফিরে আসবে রক্তে ঘামে ভিজে
কান্নার ও শব্দ আছে ভাষা তা কি বোঝে ?
প্রেম প্রীতি ভালোবাসা কুণ্ডলী পাকায় আনাড়ি
ওই দেখ ওখানে সারিবদ্ধ আসন পাতা
হৃদয় পেতেছে হাত বর্ণাক্ষরা উবুড় করেছে প্রাণ
ওখানেই এক হয়েছে জমিন আসমান
বাংলা আমার চতুর্পার্শ্বে ভাষা-অভিমান।
আরাধ্য ঈশ্বর যদি
————————-
জলের ভেতর জলের শব্দ কলস্বরা জানলো সবাই
বৃষ্টি নাচে আপন খেয়ালে পাতায় নাচে আলোর সবুজ
অক্ষর দ্যোতনা অসংখ্য অন্ধকারের বলয়ে মুক্তা আলো
নিরক্ষর লানছনা দেখেছে বর্ণহীন যত ভাষা বোধ
বিষণ্ণ ছায়া ভেঙে আসে আমাদের প্রিয় ভাষা মুখ।
জীবনের অনন্ত ভাবনায় জেগে ঈশ্বর আলো
অক্ষর ঘরে বর্ণমালায় লতায় পাতায় বর্ণময় ফুল
অবলুপ্ত তবুও অন্ধকার ভাঙে প্রতিদিন প্রাণের কিরণ
ফেলে আসা বহুকাল তবু আগলে অন্তর আকর
লোভ লজ্জায় অধুনা জন্ম কেনো যে ভাস্বর
অকারণ আঁচড়ে ক্ষত মানব হৃদয়
ঈশ্বর তবু দয়ার সাগর।
প্রাণে প্রাণ হৃদয়ের দু’পাশে জ্বলেছে রক্ত বাতি
সুন্দর সে দেহ মন কতবার পেরোবে প্রশান্ত শতাব্দী
নিভৃত কুটিরের ভেতর কথা শব্দ ভাসে জল পড়ে পাতা নড়ে
সকল সুবোধ বালক হয়ে ওঠে গোপাল
আদুরে মাসীর কান আর কাটেনি যত চোর ভুবনেরা
অকাল বৈধব্যদশা নেই অনূঢ়া ধর্ষণ যত বীভৎসতা
হায় ! এসব দেখেছিলেন আরাধ্য ঈশ্বর যদি !
____________________________________
আবদুস সালাম
~~~~~~~~~~~~~~~~
তীর্থ ক্ষেত্র
————————-
ভোরের আকাশ খুলে গেলে ভেসে আসে সংকেত
সমুদ্রোপকুল ভেঙে জন্ম নেয় মেঘ
সকাল হলেই দেখি কিভাবে বৃষ্টি নেমে আসছে বর্ণমালার আকাশে
সেদিন মৃত্যু ডানা মেলেছিল মেডিকেল চত্বরে
পরাজয় নেমে এসেছিল পাড়ামহল্লায়
বিভেদ মেতেছিল সংকটের সীমানায়
পলাশের রং লেগেছিল ভাষার তীর্থক্ষেত্রে
মাতৃভাষার বাঁশি বেজেছিল পৃথিবীর বনে
ময়ূর নেচেছিল হৃদয়ের ঘরে
অদূরে কৃষ্ঞ বাঁশি বাজিয়ে ছিল সেই সুরে
ঘুড়ি রঙের হৃদয় উড়ছে আন্তর্জাতিক বলয়ে
আজ সব তীর্থক্ষেত্র উল্লাসে মাতোয়ারা
আমার ভাষা
————————-
এখনো অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে ঘুরে আসে
রোজ দেখতে পায় দিন বদলের কানামাছি খেলা
পলাশ বনে উঁকি মারে রক্তাক্ত অভিসার
ভাষার আফিম খেয়ে নাচে কৃষক মজুর
ভাটিয়ালীর সুরে পূজা হয় বাঙলা মায়ের
ভাষার সন্তানেরা রোদ জলে ভিজে
ভাষালুটেরা গুলি চালায় নির্বিচারে
আবেগের পাখিরা ডানা ঝাপটায়
রোদ জমা হয় আলোর প্রান্তরে
ভাষার নগ্নডানায় জড়ো হয় অমানবিক -ক্ষত
কুটিল আবর্তে পাক খায় ভ্রষ্ট বিবেক
সারা পৃথিবীর মুখে মাখালো চুনকালি
নিকানো উঠোনে পুঁতে দিচ্ছি ভাষার- ফনিমনসা
লালন করছি যতনে
ভাষার কাঁটা গাছে নাকি খাদ্য শষ্য ফলে
মাতৃভাষা
————————-
ভাষা নিয়ে বেহায়াপনা ভাল্লাগেনা
স্তব্ধ চিৎকার ভেসে আসে
চুঁইয়ে পড়ে ভালোবাসার গান
আলোচ্য উচ্চারণে জমে ওঠে মেঘস্তব্ধতা
খুলে ফেলি বিদগ্ধ নিষেধাজ্ঞা
পল্লবীত সাঁতরে হাবুডুবু খায় মাতৃভাষা
পৃথিবীর মন্দিরে মন্দির বাজে কাঁসরের ঘণ্টা
মাতৃভাষার পূজা হয় পাগলের প্রলাপে
অর্ধোন্মাদ মানুষ আর্তনাদ বিদেশী ভাষায়
ভালোবাসার ভাষা কাশবনের মাথায় দুঃখের কুঁড়ে মুখ গুঁজে
____________________________________
বাংলা ভাষার জন্য
সমর ভূষণ দে
হঠাৎ স্টেশনটা জেগে উঠলো
অসংখ্য কণ্ঠস্বরে শিলচরে
বাংলা ভাষা বাঁচানোর দৃপ্ত স্লোগানে
কটমট চোখে অসম পুলিশ
রাষ্ট্রীয় সৈন্য চালালো বুলেট
ভব্যতার সীমা পেরিয়ে
সভ্য জগতের মরুভূমিতে সেদিন লুটিয়ে পড়ল
কানাই সুনীল হিতেশ তরণী কমলা
অগণিত মানুষের চোখে প্রতিবাদের ভাষা
বোমার মত ফেটে পড়ল
অসহায় মানুষ দেখলো
বাংলা ভাষা চর্চার অধিকার রক্ষার পরিণতিতে
হিংসার রক্ত
জাতিগত বিদ্বেষ
নেশন্ ভায়োলেন্স
ক্ষতবিক্ষত ডেমোক্রেসি
সন্ ঊনিশ’শ একষট্টি
কত মৃত্যু
কেঁদে ওঠে শঙ্খ
বড় বড় গাছের ছায়া গম্ভীর
রবীন্দ্রনাথ যেন চেঁচিয়ে বললেন,
বাঙালির রক্তে বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা…..
____________________________________
মাতৃভাষা
দেবাশিস মিশ্র
তার জন্যেই ছাড়তে পারি একশো তালুক,
উথালপাথাল মনের কোণায়
সাতরঙা প্রেম মগ্ন থাকুক,
স্বপ্ন মাখুক;
তারই, কেবল তারই মায়ায়
স্নেহচ্ছায়ায় ভরব মুলুক।
আহ্বানে তার ভরতে পারি আপন মুলুক,
জীবনভরের দুঃখ-ব্যথায়
একান্ত এক ভরসা থাকুক,
শান্তি জাগুক,
জড়ায় তাকেই আজ কবিতায়
দুঃখচিতায় ঝলসানো বুক।
সেই সু-ভাষার ছোঁয়ায় জাগে বিষণ্ণ বুক,
স্বেদ-শোণিতে তৈরী পাতায়
ঠাঁই করে নেয় বিপন্ন সুখ,
কিংবা অসুখ;
সেই সরোবর তোমায় আমায়
আজও জোগায় পদ্ম-শালুক।
____________________________________
মাতৃভাষা
রতন কুমার নাথ
বাংলা আমার মায়ের মুখের ছোট্ট তোতাপাখি
বাংলা আমার বোনের হাতের লাল টুকটুক আঁখি।
বাংলা আমার কবিগুরুর শুক্রবারের হাট
বাংলা আমার প্রথম বন্ধু মিষ্টি সহজপাঠ।
বাংলা আমার দাদুর ছড়া, মায়ের পিঠেপুলি,
বাংলা আমার ভায়ের মুখের আধফোটা সব বুলি।
বাংলা আমার দোলের খেলা, চোত-ফাগুনের গান
বাংলা আমার মাসিপিসির গল্প অফুরান।
বাংলা আমার কাঁসর-ঘণ্টা, সান্ধ্য আজানধ্বনি
বাংলা আমার দরবেশ গান, উমার আগমনি।
বাংলা আমার বুকের বেদন, জল ছলছল আঁখি
বাংলা আমার মায়ের মুখের ছোট্ট তোতাপাখি।
____________________________________
দহন কালের নিজস্ব কথামালা
বিরথ চন্দ্র মণ্ডল
সীমাহীন অলস সময়ে কেটে যায় রাত্রি-দূপুর,
কতদিন প্রহর গুনবে প্রিয় কথা সব……
শায়ন্তনী ;আর কতদিন হামুখ জানালায়
লেপ্টে থাকবে সপ্নিল দু’চোখ…..
এ পাথর সময়ে ফড়িং বিকেল হয়ে ধুসর কুয়াশার বুকে এসো ।
দ্যাখো ;ঘরকন্যায় মেতে যাবে চড়ুই উঠুন . …..!
জল জানি গড়ায় নীচের দিকে
ইদানীং জলেরা ভুলে গ্যাছে ধর্ম বোধ
সবার নিঃশ্বাসে করোনা আবহ
বৃক্ষ শিশুর চোখে ঘুম নেই
কতদিন পাতিঘাস ও রোদ্দুর দ্যাখেন।
যদি প্রিয়কেই ভালোবাসো… প্রকল্পিত প্রাচীর ভাঙ্গি এসো … তার পর চিলের ডানা মেলে ডেকে নিও “তোমার আমাকে “।
___________________________________
ভাষা শহিদ স্মরণে
তপন কুমার রায়
যে ভাষাতে বলব কথা
তোমার সাথে ভালোবেসে
সেই ভাষাটিই কেড়ে নিলে
আঁধার নামে এক নিমেষে।
বাংলা ভাষার জন্যে লড়াই
করল কত ভাষা প্রেমিক
তাদের কথা ক’জন জানে
মরল যারা গুলি খেয়ে।
আজো যেন বলছে তারা
বাংলা মাকে ভালবাসি
বাংলা আমার মাতৃভাষা
তোমার আমার সবার ভাষা
১ নভেম্বর শ্রদ্ধা জানাই
ভাষার জন্যে শহিদ যারা।
পুস্প মাল্যে প্রদীপ জ্বেলে
স্মরণ করি ভাষা স্তম্ভে ।
____________________________________
মাতৃভাষা
প্রণব ঘোষ
আমার সামনে বসে আছে যে মেয়েটি ও একুশে
যার শরীর থেকে গন্ধ ভাসছে সোঁদা সোঁদা
যা আমার শরীর এবং হৃদয়ে মিশে গল্প শোনায় লাল মাটির
আমি যাকে ভালোবাসি
যে নদীটা প্রতিনিয়ত বাঁক নিচ্ছে আর ভাঙছে
আমি সেই ভাঙন পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তার
শরীরের গন্ধ শুঁকছি আর আমার রক্ত-মাটিমাখা হাত
ছুঁয়ে রাখে আমার মাকে।
আমার সামনে বসে আছে যে মেয়েটি বাঙাল ঘোমটায়
ওই মেয়েটি মাতৃভাষা।
____________________________________