চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকা ১ নভেম্বর অনলাইন বিশেষ ভাষা সংখ্যা, ২০২০

 

       

           ১২তম বর্ষ : অনলাইন ৫ম সংখ্যা

 ■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

      সম্পাদক: প্রণব ঘোষ ও শুভদীপ মাইতি

        কানপাড়া : সোমড়া : বলাগড় : হুগলী 

           পশ্চিমবঙ্গ : ৭১২১২৩ : ভারতবর্ষ

      কথা : ৯৪৩৪৯৭৭৮৩০     ৯০০২৫৮৫৮৩২

    ইমেল: choutishaprokason@gmail.com

 ■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

এই সংখ্যা যাদের কলমে সমৃদ্ধ:

১ নভেম্বর ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয়  ইতিহাস : পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

গুচ্ছ কবিতা: বিকাশ চন্দ, আবদুস সালাম।

কবিতা: সমর ভূষন দে, দেবাশিস মিশ্র, রতন কুমার নাথ, বিরথ চন্দ্র মন্ডল, তপন কুমার রায় ও প্রণব ঘোষ।

 ■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

ভারতবর্ষের প্রথম ‌১ নভেম্বর অমর ভাষা শহিদ স্মারক স্তম্ভ।

উদ্বোধক: কবি অরুন কুমার চক্রবর্তী ও সাহিত্যিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

ভাস্কর: আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী রামকুমার মান্না।

স্থান: কোলড়া বাস স্ট্যান্ড, সোমড়া, বলাগড়, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

আমাদের কথা:

দেখতে দেখতে ১২ তম বর্ষে পদার্পণ করল

“চৌতিশা সাহিত্য পরিষদ”। মাঝে ১ নভেম্বর ২০১৫ ” মাতৃভাষা স্মারক স্তম্ভ” প্রতিষ্ঠা। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কেন ১ নভেম্বর” ভাষা স্মারক স্তম্ভের” স্থাপনা। এই সংখ্যায় যার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। একটু পিছনের দিকে ফিরে যাচ্ছি, অনেকেই জানেন ১ নভেম্বর: ” ভারতের প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিজয় ইতিহাস” নিয়ে ২০১৫ খ্রী: শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের  তথ্য সমৃদ্ধ পুস্তক প্রকাশ করি। ভূমিকায় বিস্তারিত আলোচনা আছে। আসলে ভাষা স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব তাঁর কাছ থেকে আসে, প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, কথামতো প্রায় তিন দিন গৃহবন্দী থেকে উল্লিখিত পাণ্ডুলিপি সর্বস্বত্বে ” চৌতিশা” কে দেন। যা পুস্তক আকারে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ১০ অক্টোবর ২০১৫ । ১ নভেম্বর ২০১৫ । মাতৃভাষা ভাষা স্মারক স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা। উদ্বোধক: কবি অরুন কুমার চক্রবর্তী ও সাহিত্যিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর: আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী রামকুমার মান্না, সহযোগিতায়: কোলড়া, বালিগড়ী বাজার কমিটি এবং সোমড়া ২ নম্বর পঞ্চায়েত। যার ফলস্বরূপ ভারত, বাংলাদেশের সাহিত্য ও‌ বুদ্ধিজীবী মহল তাঁদের ভাবনায় আনেন । আমরা গর্বিত ভারতবর্ষে প্রথম ‌১ নভেম্বর অমর ভাষা শহিদ স্মরণে ভাষা স্মারক স্তম্ভ” স্থাপন করতে পেরে। সুখের বিষয় ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠক এই দিনটিকে অমর ভাষা শহিদদের এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনে সামিল প্রেমিকদের স্মরণে গানে-কবিতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলেছেন। বাঙালি হিসাবে একজন ভারতীয় হয়ে ধন্য‌ যে আজ বাংলাদেশেও প্রথম এই দিনটিতে বাংলা ভাষার শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। “চৌতিশা ” সাহিত্য পরিষদের  পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

           আজ ” মাতৃভাষা ভাষা স্মারক স্তম্ভ” ৭ ম বর্ষে পদার্পণ করল। শ্রী চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন  বিগত বামফ্রন্ট রাজত্বকাল মানভূমে  ” ভাষা স্মারক স্তম্ভে”র  প্রতিকৃতির নির্মান শুরু হয়েছিল যা আজও অসমাপ্ত। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন রাখছি  সম্পূর্ণতা পাওয়ার জন্য।

 আজকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে “চৌতিশা”র অনলাইনের মাধ্যমে তুলে ধরছি অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ২ য় খণ্ডের ১ নভেম্বরের ইতিহাস‌ এবং বিশিষ্ট কবিদের কবিতা। শেষ করছি, করোনা আবর্তে মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত সমগ্র মানবজাতিকে বিষাদের শুভ বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা ও সুস্থ থাকার কামনায়।

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

●●●●● ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয় ●●●●●

 □ পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

মানভূমের অতীত কথা:

■■■■■■■■■■

ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে মানভূমের  ইতিহাসের সূচনা মুঘোল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের এবং তাঁর সহযোগীদের বক্সারের যুদ্ধে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে যুদ্ধে হেরে যাবার মধ্যেই  এই যুদ্ধের পরে কোম্পানি সুবে বাংলার (বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ) দেওয়ানি লাভ করে।

এরপরে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইন পাশ করে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য কোম্পানির প্রশাসন, বাংলার ভৌগোলিক এলাকার প্রশাসনিক পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিল। জন্ম হল মানভূমের।

মানভূম জেলার জেলা সদর হল মানবাজার। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ। মানভূমের সদর হল পুরুলিয়া।

বর্তমানে এই জেলার মধ্যে পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলা ,ধানবাদ,ধলভূম ,সারাইকেলা,খরসুঁয়া জেলা ( ঝাড়খন্ড জেলার মধ্যে ) পড়ে।

১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ গুলিতে মানভূমের ক্ষেত্রমান বা আকার বারে বারে কমানো হতে থাকে। যখন মানভূম জেলা গঠিত হয় তখন এর ক্ষেত্রমান ছিল২০,৪৫০/৫ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এর আয়তন দাঁড়ায় ১০,৬৫০ বর্গকিলোমিটার। 

মানভূমকে বাংলা থেকে ভাগ করার ইতিবৃত্ত:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ। লর্ড কার্জণ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু দেশের মানুষের প্রবল চাপের মুখে, আন্দোলনের মুখে তাকে সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়। কিন্তু ২২ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশ ভেঙে দুটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হল। (১) বাংলা এবং  (২) বিহার-উড়িষ্যা।

তথ্য বলছে মানভূমের জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ ছিল বাঙালী। কিন্তু তবু এই জেলাকে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হল।

বাংলার বৌদ্ধিক মানুষ,সাধারণ মানুষ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করল। উল্লেখ করা যায় বিহারের সচ্চিদানন্দ সিংহ, মোহাম্মদ ফকরুদ্দিন, দীপনারায়ণ সিংহর মত মানুষেরাও এর প্রতিবাদ করেছিলেন তখন। এই দীপনারায়ণ সিংহই পরবর্তী সময় বিহারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

উল্লেখ করা যায় জাতীয় কংগ্রেস কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে  ভাষাভিত্তিক অঙ্গরাজ্য গঠনের আদর্শেই বিশ্বাস রাখত। মহাত্মা গান্ধী বা জওহরলাল নেহেরুও এই মতেই বিশ্বাস রাখতেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশন বসেছিল নাগপুরে। এই অধিবেশনে ভাষা ভিত্তিক অঙ্গ রাজ্য গঠনের ওপর জোড় দেওয়া হয়। সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবার পরে ভাষা ভিত্তিক অঙ্গরাজ্য গঠন করা হবে। নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন  সি. বিজয়রাঘবাচার্য।  (Memorable Sessions Of the Congress in the pre-Independence years-All India Mahila Congress..)

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ। এবার প্রশাসনিক সুবিধের দিকে নজর দিয়ে ” বিহার-উড়িষ্যা ” প্রদেশকে দু’ভাগে ভাগ করে দুটি প্রদেশের জন্ম দেওয়া হল―

(১ ) বিহার  (২ ) উড়িষ্যা। অবাক কান্ড হল মানভূমের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি,তবু মানভূমকে জুড়ে দেওয়া হল বিহারের সাথে। উল্লেখ করা যায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যে আদম সুমারি হয়েছিল সেখানে তথ্য বলছে মানভূমের ৮৭% মানুষই কথা বলে বাংলায়।

মানভূমের বাঙালিদের দুঃখ কর অবধান:

■■■■■■■■■■■■■■■■■

সেই সময়ে কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি বিহারী এবং হিন্দী ভাষীদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই তৈরি করলেন একটি সংগঠন – ” মানভূম বিহারী সমিতি”। সেই সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভাই ব্যারিস্টার পি.আর দাস বাঙালিদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঙালিদের আহ্বাণ করলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিল মানভূমের বাঙালিরা। বাঙালিদের সমন্বয়ের জন্যই ব্যারিস্টার পি. আর. দাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠলো বাঙালিদের সংগঠন ” মানভূম বাঙালি সমিতি “।

মানভূমে হিন্দির অধিক প্রসারের দিকে লক্ষ রেখে মানভূমে সরকার গড়ে তুলতে থাকলো একের পর এক হিন্দি স্কুল। বাংলা মাধ্যম স্কুল গঠনের দিকে সরকার দৃকপাতই করলো না। বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাষা রক্ষার তাগিদে বাঙালিরা নিজেদের অর্থ খরচ করে কিছু বাংলা মাধ্যম স্কুল গড়ে তুলতে থাকলো মানভূমের বাঙালি অধ্যুসিত অঞ্চলে।

স্বাধীন হল দেশ / ঘুচলো না ক্লেশ:

■■■■■■■■■■■■■■

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা পেল ভারতবর্ষ। এবার ভারতের নানা প্রান্তের নানা ভাষাভাষীর মানুষেরা ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠন নিয়ে নানান দাবি তুলতে থাকলো। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজী এবং কংগ্রেস মনে করলো যদি এভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবীকে মান্যতা দেওয়া হয় তবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হতে পারে। ফলে কংগ্রেস চুপ রইলো এই সমস্ত দাবীর ক্ষেত্র গুলিতে।

ধর কমিশন:

■■■■■■■

দেশের রাষ্ট্রপতি তখন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি ১৭ জুন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি  গঠন করলেন ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিষয় গুলিকে খতিয়ে দেখার জন্য। কমিটির নাম রাখা হল  LINGUISTIC PROVINCES COMMISSION (S K DAR COMMISSION )। কমিটি গঠিত হল অবসরপ্রাপ্ত জজ( এলাহাবাদ হাইকোর্ট) এস .কে ধর,আইনজ্ঞ 

J. N. LAL । অবসরপ্রাপ্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অফিসার পান্নালাল লাল কে নিয়ে।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ধর কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করলো সরকারের কাছে। ধর কমিশনের রিপোর্টে বলা হল কেবলমাত্র ভাষার ওপর ভিত্তি করে বা এর ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য গঠন করা হলে তা দেশের বৃহৎ স্বার্থের বিরোধী হবে। তারা বললো” ” the formation of provinces on exclusively or even mainly linguistic considerations is not in the large interests of the India nation. “

ধর কমিশন এও বলে যে দেশের স্বার্থের জন্য দেখতে হবে―

                    (  ১ ) ভৌগোলিক নৈকট্য।

                    (  ২ ) প্রশাসনিক সুবিধা।

                    ( ৩  ) অর্থনৈতিক সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ।

 এর ওপর জোড় দিয়েই অঙ্গরাজ্য পুনর্গঠন করা উচিত।

এই ধর কমিশনের রিপোর্ট দেশের জনগণের মধ্যে একটি বিরূপ ধারণার জন্ম দিল। চারিদিকে এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো মানুষ।

জে. ভি .পি কমিটি:

■■■■■■■■■

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ। কংগ্রেসের অধিবেশন বসল জয়পুরে। সেখানে এই একই বিষয়ে তৈরি হল একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। কমিটির সদস্য হলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া। কমিটির নাম দেওয়া হল জে .ভি . পি কমিটি।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল এই কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। সেখানে বলা হয় – যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাই যদি জনগণের আকাঙ্খা প্রবল ও দাবি জোরালো হয় তবে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবো। দেশের সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনার প্রয়োজন হয় সেখানে  কিছু ছাড় দেওয়া হবে।

মানভূমে বিহারী নির্যাতন:

■■■■■■■■■■■

সে সময়কার কেন্দ্র সরকার যে রাজ্যগুলিকে ভাষাভিত্তিক জায়গা  থেকে পুনর্গঠন করবেন বা খতিয়ে দেখবেন রাজ্য গুলির ভাষা কেন্দ্রিক বিষয়, সেই সময় কেন্দ্র সরকার দেখছে রাজ্য গুলিতে জনগণের মাতৃভাষা সুরক্ষিত কিনা, তখন বিহার সরকার ঘোষণা করে দিল সেখানকার রাজ্যভাষা হবে একমাত্র হিন্দি।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তখন শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। সরকার নির্দেশিকা জারি করলো। নির্দেশিকায় বলা হল-

প্রথমত- প্রাথমিক স্তর থেকেই পড়ুয়াদের শুধুমাত্র পড়তে হবে হিন্দিতে। হিন্দি ছাড়া অন্য কোন ভাষায় পাঠ দান বা পাঠ গ্রহণ চলবে না।

দ্বিতীয়ত- সমস্ত স্কুল গুলিতে স্কুলের যে সাইনবোর্ড থাকবে তাতে কেবলমাত্র হিন্দিতেই স্কুলের নাম লেখা যাবে।

তৃতীয়ত- কোন রকম বাংলা প্রর্থণা গান গাওয়া যাবে না। গাইতে হবে রাম ধূন। (সার্কুলার/বিদ্যালয় পরিদর্শক/নং ৭০০/৫ আর/তাং ১৮ মার্চ,১৯৪৮)।

চতুর্থত- বাঙালিদের সব সময়ে বাসস্থানের নথি (ডেমিসাইন সার্টিফিকেট ) নিয়ে সব জায়গায় যেতে হবে। কতৃপক্ষ চাইলে তা দেখাতে হবে।

পঞ্চমত- সরকারের সমস্ত রকম কাজ কর্মের ভাষা হিন্দিতে করতে হবে। অন্য ভাষায় সরকারি কাজ করা যাবে না।

মানভূমের বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াই শুরু হল। উল্টোদিকে বিহার সরকার বাংলা ভাষা বিরোধী জান্তব আইন গুলিকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেখানকার বাঙালিদের ওপর।

লোকসেবক সংঘের জন্ম:

■■■■■■■■■■■■

মানভূম জেলা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। তিনি পদত্যাগ করলেন কংগ্রেস থেকে। পদত্যাগ করলেন বিভূতিভুষণ দাশগুপ্ত, অরুণচন্দ্র ঘোষের মত কংগ্রেসের মানভূম এর  আরো ৩৭ জন গান্ধীবাদী নেতা। এঁরা প্রত্যেকেই গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। গঠন করা হল নতুন রাজনৈতিক দল “লোকসেবক সংঘ”। মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের নতুন অধ্যায় শুরু হল।

এই সময় নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত “মুক্তি” পত্রিকায় বাংলা ভাষীক মানুষের ওপর বিহারী অত্যাচার এবং বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের তীব্রতার নানা খবর প্রচার করা হয়েছে। আর এগুলি সেই সময়ের বাংলা ভাষা আন্দোলনের দলিল হয়ে আছে বাঙালির মননে।

মুক্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে বরাবাজার থানার হেরবনা গ্রামে সরকারি ধান্যগোলা থেকে অনুদান দেবার সময় বাংলায় লেখা দরখাস্ত গুলি বাতিল করে দেওয়া হয়। আবেদনকারীদের হিন্দিতে দরখাস্ত লিখতে বাধ্য করা হয়। 

ঝরিয়া দেশবন্ধু সিনেমা হলে বিজ্ঞাপন দেখাবার সময় দেখানো হতো-

HINDI IS THE MOTHER LANGUAGE OF MANBHUM.

মানৃভূমের যেখানে সেখানে ঘোষণা করা হতো-

“মানভূম বঙ্গাল মে নহী জায়েঙ্গে, জানে পর খুন কে নদী বহা দেঙ্গে। “

লোকসভায় মানভূমের প্রসঙ্গ:

■■■■■■■■■■■■■

ভাষা ভিত্তিক রাজ্য  পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মানভূম, সেরাইকেল্লা, খরসোয়ানের আন্দোলনকে বিহারের হিন্দি প্রেমি সরকারের জঘন্য আচরণকে মানতে পারা যায়না বলে জওহরলাল নেহেরুকে জানালেন সুচেতা কৃপালনী, এন .সি. চ্যাটার্জী সহ পাঁচজন সাংসদ। আলোচনার তারিখ -২৮ ফেব্রুয়ারি ,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। 

মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পত্র পত্রিকা:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সমর্থণ করে  বেশকিছু পত্র পত্রিকায় জ্বালাময়ী কলাম প্রকাশিত হতে থাকে সেই সময়। এই লেখাগুলি মানুষের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বালতে সহযোগিতা করেছিল তখন। তেমন কিছু পত্রিকার নাম আমরা এইভাবে উল্লেখ করতে পারি –

                          ( ১ )  মুক্তি

                          ( ২ ) মর্মবাণী

                          ( ৩ ) কল্যাণবার্তা

                          ( ৪ )  হরিজন-কল্যান সংবাদ

                          ( ৫ ) পল্লীসেবক

                          ( ৬ )  তপোবন

                          ( ৭ ) অগ্রগামী।

আবার এর  উল্টো ছবিও সে সময় দেখা যায় মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে। বেশ কিছু হিন্দি পত্রিকাতে মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে প্রায় উপহাসের সুরে বেশ কিছু কলাম প্রকাশ পায় সে সময়। তেমন কিছু পত্রিকার নাম আমরা এইভাবে উল্লেখ করতে পারি-

                        ( ১ )   নিরালা

                        ( ২ )  প্রগতি

                        ( ৩ )  নির্মাণ

                        ( ৪ )  জনসেবক

                        ( ৫ )  সমবেত।

সত্যাগ্রহের পথে:

■■■■■■■■

লোকসেবক সংঘ বাংলা ভাষার মর্যাদার রক্ষার্থে শুরু করলো সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচী। এই আন্দোলনে একই সাথে চলতে থাকলো সভা-সমিতি -সমাবেশ। চলতে থাকলো গ্রাম ভিত্তিক মিছিলের কর্মসূচী। ঘরে ঘরে পালিত হতে থাকলো অরণ্ধন কর্মসূচী।

এরই মধ্যে পশুর মত হিংস্র হয়ে উঠলো তখনকার বিহার সরকার। মানভূমের মানুষদের না খাইয়ে মারার জন্য মানভূমে চাল আমদানী বন্ধ করে দিল বিহার সরকার। আন্দোলন কারীরা বাঁকুড়া থেকে চাল এনে খাদ্য সমস্যা মেটাতে চাইলো। সমস্ত মানভূম জুড়ে শুরু হল খাদ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

এবার বিহার সরকার চাষ বাস বন্ধ করে দেবার জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পরোয়া না করে প্রকাশ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয় শুরু করলো। এই আন্দোলনকে বলা হল হাল-জোয়াল সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

বিহার সরকার বাংলা ভাষীক মানুষদের ভাষা আন্দোলনের যে কোন রকম সভা সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। এতে মানুষ আরো বিরক্ত হয়ে উঠলো। মানুষ ক্ষেপে গেল। আন্দোলনের গতি আরো তীব্রতা পেল সে সময়।

হিন্দি সন্ত্রাসবাদ:

■■■■■■■■■

বিহার সরকার সে সময় ছাত্র শিক্ষক ছাড়াই গোয়ালঘরে বা বাড়ির বৈঠকখানায় রাতারাতি গজিয়ে তুলতে থাকলো হিন্দি স্কুল।

সার্কুলার নং ১/ ৬-৫-৪৮, ১৮/০৩/৪৮, শ্রীকানাইলাল, ডি .আই অফ স্কুল ; বিষয়- ৭২ টি আদিবাসী স্কুলকে হিন্দি স্কুলে পরিণত করা। আবার এই বিষয়টি বার্ষিক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল সেই সময়।

সার্কুলার নং 700-11-G-S-48/701/5R-6-48 ;18/03/48 । বিষয়-সমস্ত স্কুল পরিদর্শকদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ – স্কুল অনুমোদনের শর্ত হল রামধুন গান এবং হিন্দিভাষী না হলে অনুদান প্রত্যাহার করা হবে।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সর্বজন স্বীকৃত একটি বিষয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে, ওয়ার্ধাতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলন এবং হরিপুরা কংগ্রেসে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিষয়েই অগ্রাধীকার দেওয়া হয়েছিল।

এর পরেও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়া জেলা স্কুলে বাংলা ও হিন্দি দুটি বিভাগ থাকলেও বাংলা বিভাগকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র হিন্দিতেই পঠন পাঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ছাত্ররা |শুরু হয় ছাত্র ধর্মঘট। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত মানভূম জুড়ে বন্ধ্ কর্মসূচীতে ব্যাপক সাড়া ফেলে মানুষের মনে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। বান্দোয়ানের চিরুডি ও বান্দুডাবর গ্রামে হিন্দির কুশীলবরা  জনসভা করে ঘোষণা করে যে মানভূমের ভাষা কেবল হিন্দি। মানুষকে লোভ দেখিয়ে বলে হিন্দি ভাষা শিখলে তাকে বা তাদের বাধ, কুয়া, পুকুর এবং টাকা দেওয়া হবে।

বিহার পুলিশ টুসু গায়ক, দশ বছরের অন্ধ বালক বাবুলালকে গ্রেপ্তার করে হাজারিবাগ জেলে নিয়ে যায়। যাবার সময় ওই অন্ধ বাচ্চা ছেলেটিকে মাঝপথে একা একা ছেড়ে দেয়। কতটা অমানবিক হলে এমন কাজ কোন মানুষের ওপর মানুষ করতে পারে!

মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা দেবীকে প্রকাশ্যে বিহার পুলিশ এবং বিহারী গুন্ডারা চুলের মুঠী ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মাটিতে ফেলে চরম মারধোর করে। তারা ভুলে যায় এই মহিলা গান্ধীজীর লবন সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের স্নেহ ভাজন সত্তা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি আদালত থেকে পর্দা চুরি করেছেন।

শবরদের কাছে দেবতার মত মানুষ ছিলেন রেবতী ভট্টাচার্য। তাঁকে পিটিয়ে আধমরা করে বিহার পুলিশ ফেলে যায় জঙ্গলে। লোকসেবক সংঘের সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার না করলে তিনি হয়তো জঙ্গলেই শহিদ হয়ে যেতেন।

বরাবাজার স্কুলে গোলমালের পরে শ্রদ্ধেয় নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তকে বিহার পুলিশ গুম করে রাখে। লোকসেবক সংঘের জনগণ প্রায় চিরুনি তল্লাসী করে তাঁকে উদ্ধার না করলে তাঁকেও হয়তো মেরে ফেলা হতো।

১২ থেকে ১৩ বছরের ছেলে সুধন্য মাহাত ও হরিপদ মাহাতকে বিহারী পুলিশ জরিমানা করে। তারা টুসু সত্যাগ্রহে অংশ নিয়েছিল বলে তাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। বাদ যায়না তাদের বলদ, গরু, মোষ, ঢেকি পর্যন্ত। প্রতিবাদে লেখা হয় টুসু গান।

              ” সুধন্যার ঢেঁকি

                 দারোগার বউ

                 ধানকুটে

                 সবাই দেখি। “

টুসু সত্যাগ্রহ:

■■■■■■■

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল টুসু গান, টুসু সত্যাগ্রহ। জননেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ লোকসেবক সংঘের মাধ্যমে মানভূমের বঙ্গভূক্তির জন্য গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন টুসু সত্যাগ্রহের হাতিয়ারকে সামনে রেখে।

লোকসভার সদস্য ভজহরি মাহাত  বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক টুসু গানের সৃজন করেছিলেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত টুসু গান –

        ” শুন বিহারী ভাই

          তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই

          তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি

           বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।

           ভাইকে ভুলে করলি বড়

           বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।

           বাঙালি-বিহারী সবাই

           এক ভারতের আপন ভাই

           বাঙ্গালীকে মারলি তবু

           বিষ ছড়ালি-  হিন্দী চাই।

           বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই

           কোন ভেদের কথা নাই

           এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে

           মাতৃভাষায় রাজ্য চাই।”

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রগণ্য নেতার নাম অতুলচন্দ্র ঘোষ। তাঁর বড় ছেলে অরুণচন্দ্র ঘোষ। তিনি মানভূম ভাষা আন্দোলনের ওপর বেশ কিছু টুসু গান সৃজন করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গান-

“আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষারে

(ও ভাই )মারবি তোরা কে তারে

এই ভাষাতেই কাজ চলেছে

         সাত পুরুষের আমলে ;

এই ভাষাতেই মায়ের কোলে

মুখ ফুটেছে মা ব’লে।

এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড

      এই ভাষাতেই চেক- কাটা

এই ভাষাতেই দলিল নথি 

       সাত পুরুষের হক পাটা।

দেশের মানুষ ছাড়িস যদি

           ভাষার চির অধিকার।

দেশের শাসন অচল হবে

         ঘটবে দেশে অনাচার।”

এই অরুণচন্দ্র ঘোষই অন্য একটি টুসু গানে লেখেন-

     “আমার মনের মাধুরী

      সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি।

      আকাশ জুড়ে বিষ্টি নামে

      মেঠো সুরের কোন্ ঢুয়া

      বাংলা গানের ছড়া কেটে

      আষাঢ় মাসে ধান রুয়া।

       -মনের  মাধুরী 

       মনসা গীতে বাংলা গানে

       শ্রাবণে জাত-মঙ্গলে

       চাঁদ-বেহুলার কাহিনী পাই

       চোখের জলে গান ব’লে।

       বাংলা গানে করি লো সই

       ভাদুপরব ভাদরে

       গরবিনীর দোলা সাজাই

       ফুলে-পাতায় আগরে।

       বাংলা গানে টুসু আমার 

       মকর দিনের সাক্ রাতে

       টুসু ভাসান পরব টাঁড়ে টুসুর গানে মন মাতে।”

সতনপুর গ্রামের  (চাষ থানার) জগবন্ধু ভট্টাচার্য হরিদাস ছদ্মনামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে টুসু গান সৃজনে কলম ধরেণ।  টুসুর ভেতর দিয়ে বিহারী সরকারের জান্তব ব্যবহারকে তুলে ধরেন। তাঁর লেখা একটি গান-

           “প্রাণে আর সহে না

            হিন্দী কংগ্রেসীদের ছলনা।

            ইংরাজী আমলে যারা গো

           করতো মোসাহেবিয়ানা

           এখন তারা হিন্দী কংগ্রেস

            মানভূমে দেয় যাতনা।”

জগবন্ধু ভট্টাচার্য তাঁর একটি টসু গানে সত্যাগ্রহীদের সাবধান করছেন বিহার সরকারের দমন পীড়নের বিষয়ে এইভাবে-

         ”  মানভূমবাসী থাকবে সতরে

             ধলভূমবাসী থাকবে সতরে।

             ( হিন্দির ) ফন্দী এল জীপগাড়ি ভরে। ধুঃ

             যত টাকা কেবল ফাঁকা

             বাঁধ কুয়ারই খবরে

             ( মিথ্যা )   চালান কাটি,নিচ্ছে লুটি

              হিন্দী ভাষার প্রচারে।

              ( তাই ) এদের তরে চাষের অন্ন

               দাও এখন বাঁধা দরে

               নইলে পরে কেমন করে

               মরবি ক্ষুধায় ভাদরে।

               সেদিন এরা কেউ ছিল না

               থাকবে নাকো এর পরে

               ( এখন ) এত ব্যথা গোপন কথা

               ( শুনায় )কমিশন ডরে।”

আদ্যন্ত গান্ধীবাদী কাননবিহারী ঠাকুর টুসু সত্যাগ্রহকে সমর্থন করে লেখেন-

                  ” স্বাধীন জীবনে

                    এবার মিলব রে জনে জনে। রং

                    সত্য পথে চল্ রে সবাই

                    গান্ধী-বাণী রাখ্ মনে।

                    কানন বলে পাবি আরাম

                    বাংলা ভাষার জীবনে।”

মধুসূদন মাহাত থাকতেন বাঁশাবুরু। তিনি টুসু গান বাঁধলেন-

                 ”   মন মানে না হিন্দীরে সইতে।

                     ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।

                     মাতৃভাষা হরে যদি

                     আর কি মোদের থাকে রে।

                     ( তাই ) মধু বলে মাতৃভাষায়

                      ধ্বজা হবে বহিতে।”

আবার “বাংলা লোকসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপাদান” গ্রন্থে ড.রবীন্দ্রনাথ শাসমল একটি টুসু গানের সন্ধান দিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে-

  ” পাটনা বিহীর আইন সভায়

     হিন্দী ভাষীর দল ভারী

     ( তাই )ভোটের জোরে ভাঙছে তারা

     লোকসেবকের কলগাড়ী।

      আইন সভায় হিন্দী ভাষার

      হুকুমদারী চালাতে

      বাংলা ভাষা করছে দমন

      মানভূমের জ্বালাতে।

      মাতৃভাষায় প্রদেশ গঠন

      গোটা দেশের নীতিরে

      ( পাছে ) এই নীতিতে জেলা হারায়

      বিহারের এই ভীতিরে।

      মানভূমেরই মাতৃভাষা

      বাংলা ভাষা চারধারে।

      সেই কারণে বাংলা দমন

      চালায় বিহার সরকারে।

      হোক না যতই পীড়ন দমন

      হিন্দী রাজের অত্যাচারে

      লোকসেবকের অটল গাড়ী

      টলবে নাকো কোনো ধার।

      ভাষার নীতি করতে বিচার

      কমিশনে ভার দিল

      হিন্দী রাজের মাথায় এবার

      বিষম বিপদ পড়িল।

      বাংলা বিহার মামলা দায়ের

      ভাষা ভিত্তিক স্টেশনে

      জনমতের বাজবে বিগুল

      বিচারের কমিশনে।

      চলল এবার ইঞ্জিন ঐ

      পুরু আছে কয়লাজল।

      ( এবার ) মিথ্যাচারীর টলবে আসন

      মিথ্যা হবেরে বিকল।

      ভাষা নীতির টিকিট আছে

      যাবিরে আজ কোন খানে।

      হওরে এবার জংশন পার

     লোকসেবকের ইঞ্জিনে‌।”

নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত:

■■■■■■■■■

মানভূমের স্বাধীনতার ইতিহাসে নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তকে বলা হয় মানভূমের গান্ধী। অসহযোগ আন্দোলন, শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশবোধে উদ্বুদ্ধ করার সার্থক চেষ্টা এবং যার জন্য মহাত্মা গান্ধী এই আশ্রমের নাম দেন নিবারণ আশ্রম, দেশবন্ধু প্রেস স্থাপন, মুক্তি ( ২১/১২/১৯২৫) পত্রিকা প্রকাশ এবং স্বদেশবোধের লেখা ছাপানো, সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে একাধিকবার জেলে যাওয়া-আর এই সমস্ত কিছু নিয়েই তিনি মানভূমের গান্ধী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত।

অতুলচন্দ্র ঘোষ:

■■■■■■■

মানভূমের স্বাধীনতার ইতিহাসে ঠিক এভাবেই স্মরণ করা হয় আর একটি নাম – “মানভূমকেশরী” অতুলচন্দ্র ঘোষ‌। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বি.এ পাশ করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে পুরুলিয়া কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিবাহ করেন মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা দেবীকে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল সময়ে কোর্টের কাজ q যোগ দেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন,লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মানভূম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হন। তখন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত। নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের মৃত্যুর পরে তিনি১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মানভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হন। তখন সম্পাদক হন বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯২১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত বহুবার কারা বরণ করেছেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেপ্তার হন নিরাপত্তা আইনে।

উল্লেখ করা যায় তিনিই ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় তিন হাজার পঞ্চায়েত গঠন করেণ মানভূমে। কিন্তু ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিহার সরকার বাংলা ভাষা এবং বাঙালি দমনের যে জান্তব অধ্যায় শুরু করে,বার বার কংগ্রেসের রাজ্য ও জাতীয় স্তরে বলেও কিছু হয় না, বাধ্য হয়েই তিনি কংগ্রেস ছেড়ে গঠন করেণ নতুন দল “লোকসেবক সংঘ”। টুসু সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেণ তিনি। এই আন্দোলনকে সামনে রেখে যে সমস্ত টুসু গান লেখা হয়েছিল সেই গানগুলি সংকলিত করে ” টুসুগানে মানভূম “নাম দিয়ে প্রকাশ করেণ তাঁর পুত্র অরুণচন্দ্র ঘোষ।

কে.বি.সহায়ের  অপচেষ্টা:

■■■■■■■■■■■

বিহারের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী তথা সেই সময়ের রাজস্ব মন্ত্রী কে.বি সহায় ঘোষণা করেণ – লোকসেবক সংঘ সদর মানভূমকে পশ্চিমবাংলায় নিয়ে যাবার যে রাজনৈতিক টুসু আন্দোলন করছেন তা বিপদ জনক। তার উদ্দেশ্য বিহার সরকারের নিন্দা করা। হিন্দি ভাষীদের গাল দেওয়া। প্রসঙ্গত বলা যায় তিনি ইংরাজি তর্জমা করেন ভজহরি মাহাতর লেখা –

“শুন বিহারী ভাই

তোরা রাখতে নারবি

ডঙ্গ দেখাই |”

এর অনুবাদ করেন -HEAR BIHAREE BROTHERS ,YOU CANNOT KEEP US WITH BIHER BY SHOW OF LATHI (FORCE).

জগবন্ধু ভট্টাচার্যের একটি গানকে অনুবাদ করা হয় এইভাবে-

“প্রাণ আর সহেনা

হিন্দী কংগ্রেসীদের ছলনা |”

অনুবাদ-

OUR SOULS CAN NO LONGER BEAR THE TRICKS OF THE HINDI SPEAKING CONGRESSMAN.

বিহারের অত্যাচার:

■■■■■■■■■

এবার বিহার সরকার টুসু সত্যাগ্রহীদের দমনের জন্য১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের মধ্যে বিহারের জন নিরাপত্তা আইনের ৯ ( ৫ ) ধারায় পাঁচটি দলে ১৭ জন টুসু সত্যাগ্রহীকে এবং ভারতীয় দন্ডবিধির ১৪৩ (বে-আইনি জনতা), ২২৫(সরকারি হেফাজত থেকে আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা) এবং ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধা দান) ধারায় লোকসেবক সংঘের অতুলচন্দ্র ঘোষ, সাংসদ ভজহরি মাহাত, লাবন্যপ্রভা দেবী, অরুণচন্দ্র ঘোষ, সাংবাদিক অশোক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে।

সে সময় অতুলচন্দ্র ঘোষ ৭৩ বছরের বৃদ্ধ। ব্রঙ্কাইটিসের রুগী। নিন্ম রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভুগছেন। তাঁকে তৃতীয় শ্রেনির বন্দিদের মতই খোলা ট্রাকে করে জেলে নিয়ে যাওয়া হল। পরে ঐ খোলা ট্রাকেই পুরুলিয়া জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হল হাজারিবাগ জেলে। পুরুলিয়া থেকে যার দূরত্ব  ১৩৫ মাইল।

ভজহরি মাহাত ছিলেন সাংসদ। তাঁকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আদালত তাঁদের এগারো মাসের কারাদন্ডের সাজা দিল।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। মানভূম জননী লাবন্যপ্রভা ঘোষকে  জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর.বি.সিং একমাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দিল। ১০০ টাকা জরিমানা। অনাদায়ে একমাস বিনাশ্রমে জেল।

৮ মার্চ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের “মুক্তি”পত্রিকা জানাচ্ছে টুসু সত্যাগ্রহীদের আরও পাঁচটি দলের ২৩ জনকে কারাদন্ড, লাবন্যপ্রভা দেবীর আরো এক দফা কারাদন্ড এবং জরিমানা, হেমচন্দ্র মাহাতর আরও দুই দফা কারাদন্ড ও জরিমানা, এম. পি ভজহরি মাহাতর আরো এক দফায় এক বছরের কারাদন্ড ও একহাজার টাকা জরিমানা, এম.এল.এ   সমরেন্দ্র ওঝার এক বছরের কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা। অন্ধ বালক বাবুলাল মাহাতর কারাদন্ড ও দুশো টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদন্ডর আদেশ জারি হল।

অরুণচন্দ্র ঘোষ সহ আরে চারজনের চোদ্দ মাস জেল, সাংবাদিক অশোক চৌধুরী, রামচন্দ্র অধিকারীকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা  এবং অনাদায়ে আরো তিনমাস বিনাশ্রমে কারাদন্ড। বিহার বিধানসভার এম.এল.এ  শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জীর এক বছরের কারাদন্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা হল।

বান্দোয়ার থানার মধুপুর গ্রামের কুশধ্বজ মাহাতর নাবালক পুত্র সুধন্ধা মাহাতর নয় মাস কারাদন্ড। এক হাজার টাকার জরিমানা। অনাদায়ে তিন মাস সশ্রম কারাদন্ড হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি তার বাড়ির সমস্ত কিছু ক্রোক করে নেয় পুলিশ।

২ মার্চ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে হবিবুল্লা নামের সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে গিয়ে মানবাজার থানার পিটিদারি গ্রামে টুসু সত্যাগ্রহীদের জরিমানা আদায়ের নামে বাড়ির তালা ভেঙে সম্পত্তি ক্রোক করে, মহিলাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।

১৬ মার্চ ১৯৫৪ নয় মাস কারাদন্ডে দন্ডিত অতুলচন্দ্র ঘোষকে দেড়মাস কারাভোগের পর হাজারিবাগ জেল থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী লাবন্যপ্রভা ঘোষ, ভাবিনী মাহাতকে পুরুলিয়া জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় হাজারিবাগ জেলে। শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জী, সমরেন্দ্র ওঝা সহ একুশ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় হাজারিবাগ জেলে।

বিহার সরকার হিন্দি ভাষা প্রচারের জন্য তিরিশ লক্ষ টাকা অনুদান দেন তখন। সেই টাকা পা চাটা নেতারাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেন।

লোকসভায় মানভূম নিয়ে এন.সি.চ্যাটার্জী:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

২৯ মার্চ,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। লোকসভাতে শিক্ষাখাতে দাবি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় এন. সি.চ্যাটার্জী মানভূমের টুসু সত্যাগ্রহীদের ওপর বিহার সরকারের দমন পীড়নের বিষয়টিতে প্রতিবাদ করেন। তিনি আবেদন করেন ১৯৩১ এর জনগণনা অনুসারে মানভূম সদর মহকুমায় শতকরা ৮৭ জন মানুষ বাংলা ভাষী। বাংলা ভাষার ওপর সেখানে দমন পীড়ন চলছে।

বিহার বাংলা সংযুক্তির অপচেষ্টা:

■■■■■■■■■■■■■■

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই পাটনাতে একটি বিশেষ সভায় বিহারের সি.এম  শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, বিহারের শিক্ষা সচীব বদ্রীনাথ শর্মা, রাজস্ব সচীব কৃষ্ণবল্লভ সহায়, তথ্য সচিব মহেশপ্রসাদ সিংহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অতুল্য ঘোষ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কূট চালের শিকার হয়ে যান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

বিধানচন্দ্র রায় সাংবাদিক সম্মেলনে জানান-

প্রথমত – বিহারে বাংলা ভাষার নিরাপত্তার জন্য বিহার সরকার চেষ্টা করছে।

দ্বিতীয়ত- খুব তারাতারি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

তৃতীয়ত- শোনা গেছিল বিহারে বাংলা ভাষার অনুশীলনের অনেক অভিযোগ। কিন্তু বিহারে ছাত্রদের বাংলা ভাষা অনুশীলনে কোন বাধা নেই।

চতুর্থত- বিহার সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ গুলি সম্পূর্ন ভিত্তিহীণ।

পঞ্চমত- অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে তদন্ত দরকার। বিহার সরকার খুব তারাতারি তার উত্তর দেবে।

বিনোদানন্দ ঝাঁ এর মিথ্যাচার:

■■■■■■■■■■■■■

কিন্তু ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই কংগ্রেস নেতা বিনোদানন্দ ঝাঁ  পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে বান্দোয়ান কল্যান সমিতির সভাতে বিহার সরকারের হয়ে বলেন-  “মানভূম বঙ্গাল মে নহী জায়েঙ্গে, জানে পর খুন কে নদী বহা দেঙ্গে”। “মানবাজারে পোস্টার লেখা হয় “মানবাজারবাসী বোল রহী বিহার মে রহেঙ্গে |”

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন:

■■■■■■■■■■

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ খিস্টাব্দে মাদ্রাজের কুর্ণুলে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের  চেয়ারম্যান  সৈয়দ ফজল আলি বলেন- এই কমিশন সুবিচার দেবার চেষ্টা করবে। কমিশনের কাছে যে সমস্ত অভিযোগ জমা হবে তা সত্যতার সাথেই বিবেচনা করা হবে।

পোত্তি শ্রীরামালুর আত্ম ত্যাগ:

■■■■■■■■■■■■

উল্লেখ্য তেলেগু ভাষীদের দাবী মতই লোকসভাতে বিল আসে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট, এবং অক্টোবরে গঠিত হয় অন্ধ্রপ্রদেশ। মাদ্রাজে তেলেগু ভাষীদের জন্য পৃথক রাজ্য গঠনের আন্দোলন চলছিলো। আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহী পোত্তি শ্রীরামালু। এই স্বাধীনতা সংগ্রামী তেলেগু ভাষীদের পৃথক রাজ্য গঠনের দাবীতে অনশণ করে ৫৮ দিনের মাথায় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ হন এই মৃত্যু  ভারতের অন্যান্য ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি দেয় সে সময়।

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনে আর্জি:

■■■■■■■■■■■■■■

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কেন্দ্র সরকার গঠন করে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। এর নাম দেওয়া হয় S.R.C(STATES REORGANISATION COMMISSION) ।

এই কমিশনের সদস্য হন এইচ .এন খাঙ্গুরু,  কে.এম.পানিক্কর। চেয়ারম্যন হন  সৈয়দ ফজল আলি।

উল্লেখ করা যায় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে পুরুলিয়া বার অ্যাসোসিয়েশন সহ বেশ কিছু সংগঠন স্মারক লিপি দিয়ে বলে মানভূম ও ধলভূমকে কিভাবে অন্যায় করে বিহারের সাথে যোগ করা হয়েছিল।

দাবী করা হয় সমস্ত মানভূম জেলা, সিংভূম জেলার ধলভূম মহকুমা বাংলা সংলগ্ন ৫,৩০০ বর্গমাইল জুড়ে যে বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষা বহমান তাকে বাংলার সাথে যুক্ত করা হোক। এখানে বলা হয় বিহার সরকার কিভাবে বঙালিদের ওপর অত্যাচার করছে সে কথাও।

“সংগঠন” পত্রিকার সম্পাদক স্বামী অসীমানন্দ, যিনি বিপ্লবী অন্নদাকুমার চক্রবর্তী, তিনি হিন্দি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কলম ধরলেন।

বিহারের অপচেষ্টা:

■■■■■■■■■■

২৩ আগস্ট ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ, “মুক্তি” পত্রিকায় লেখা হয় বিহার সরকারের মন্ত্রী মানভূমের নানা গ্রামে গিয়ে মানুষকে কিভাবে ভুল বোঝাচ্ছে। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয় বিহারে থাকতে চাইছে লেখা স্মাকরলিপিতে কিভাবে জাল সই সংগ্রহ করছে বিহার সরকার।

লোকসভাতে মানভূম প্রসঙ্গে সুচেতা কৃপালনী ও এন.সি.চ্যাটার্জী:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে লোকসভাতে সাংসদ সুচেতা কৃপালনী এবং সাংসদ এন.সি চ্যাটার্জী জানালেন বিহার সরকার কিভাবে অন্যায় আচরণ, অমানবিক আচরণ করছে মানভূমের মানুষের ওপর। এই আচরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

সাংসদ চৈতন্য মাঝির সংসদে ভাষণ:

■■■■■■■■■■■■■■■■

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর লোকসভায় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সিদ্ধান্ত বিষয়ে সাংসদ চৈতন্য মাঝি ভাষণ দেন। তিনি বলেন –

“আমরা বিহারের বাংলাভাষা অঞ্চলগুলি চেয়েছি। সেই সকল অঞ্চলে আদিবাসীদের নিজস্ব কোন ভাষা নেই। তাঁরা একমাত্র বাংলাতেই কথা বলেন। যেমন ভূমিজ, দেশওয়ালি মাঝি, কড়া, মুদি মাহলি ইত্যাদি। এবং প্রকৃতপক্ষে সাঁওতালরাই নিজেদের একমাত্র আদিবাসী বুলি বলেন এবং তার সঙ্গে বাংলা বলেন-যা তাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা।

সাঁওতালরা বিহারে সংখ্যায় ১৭ লক্ষ। তাদের অধিকাংশ এইসব বাংলাভাষী অঞ্চলে বাস করে। যদি এই সমস্ত অঞ্চল বাংলায় যুক্ত হয়,তবে এই সকল অঞ্চলের ১২ লক্ষ সাঁওতাল বাংলার সাড়ে ছয় লক্ষ সাঁওতালের সঙ্গে যুক্ত হবে।

বিহার সরকার দাবি করেছেন যে, আদিবাসীদের সামাজিক জীবনের সম্বন্ধ বিহারের সঙ্গে। সে-কথা ভিত্তিহীন। আমাদের সমস্ত সামাজিক সম্বন্ধ পশ্চিম বাংলার সঙ্গে। আমাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জীবন বাংলার সংস্কৃতি অনুযায়ী”। (এই বক্তৃতার অংশটি ছাপা হয় ২ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের “মুক্তি” পত্রিকায়)। 

সাঁওতালরা ১৭ লক্ষ বিহারে থাকে। তারা বাংলা বলে। বাংলার সাথে সাঁওতালদের এই অঞ্চল যুক্ত হলে এক বিরাট জনজাতির অঞ্চল বাংলায় আসবে। কিন্তু বিহার সরকার দাবি করে সাঁওতালদের সাথে তাদের যোগই বেশি। কিন্তু সাঁওতালরা বলে বাংলার সাথেই তাদের সাংস্কৃতিক যোগ। 

আদালতের বিচার:

■■■■■■■■■■

টুসু সত্যাগ্রহ প্রসঙ্গে “মুক্তি” পত্রিকা ধারাবাহিক কলাম প্রকাশ করে যাচ্ছিল। ২ জানুয়ারি ১৯৫৬ তে সেখানে লেখা হয় পুরুলিয়ার জজ কোর্টে টুসু সত্যাগ্রহীদের ১ম দফার রায়ে বলা হয় টুসু সত্যাগ্রহীদের ১৮ টি আপীল জজ কোর্টে দায়ের করা হয়। ১৬ টি আপীলের ৪৩ জন সত্যাগ্রহীদের সম্বন্ধে রায় দেওয়া হয়। 

নিন্ম আদালতে বি. এম. পি .ও ( বিহার মেনটেনেন্স অব পাবলিক অর্ডার ) এ্যাক্টের ৯ (৫) ধারায় ৪৩ জনের ছয় মাস থেকে এক বছর কারাদন্ড পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড বা বিনাশ্রমে কারাদন্ড এবং দুশো থেকে এক হাজার পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে এক মাস থেকে তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ডের আদেশ হয়। আবার কিছু সত্যাগ্রহীর বেলায় ঐ একই ৯(৫) ধারায় ২ দফা থেকে ৫ দফা পৃথক পৃথক সাজা হয়। এই সত্যাগ্রহীদের মধ্যে একজন ছিল অন্ধ বালক ও দুইজন মহিলা। একজন রাঘব চর্মকার এরই মধ্যে মারা গেছিলেন। 

এই আপীলের রায়ে অশোক চৌধুরী ও অরবিন্দ ওঝাকে বেকসুর খালাস করা হয়। আরও চারজন সত্যাগ্রহীকে যাদের বিরুদ্ধে ঐ একই ৯(৫)ধারায় ৩মাস থেকে ৫ দফায় সাজা হয়েছিল তাদের দু একটি দফায় খালাস দিয়ে বাকী দফায় সাজা দেওয়া হয়।

অন্ধ বালক বাবুলাল মাহাতকে দুই দফায় মোট ৩ মাস বিনাশ্রমে কারাদন্ড এবং ২০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৪ সপ্তাহ কারাদন্ড দেওয়া হয়। বাবুলাল এরই ভেতর আট মাস জেল খেটে বের হয়।

আপীলের সবাই নিন্ম কোর্টের দন্ড কমিয়ে ২ মাস সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিন থেকে এক মাস কারাদন্ডের আদেশ বহাল রাখা হয়েছিল।

আপীলগুলি দায়ের করার প্রায় দুই বছর বাদে মাত্র ১৬ টি মামলার রায় প্রকাশ পেল। এর ভেতর প্রায় সত্যাগ্রহীরা ৬ মাস থেকে ১ বছর জেল খেটে বের হয়ে গেছিল। কেউ কেউ ২১ মাস অবধী জেল খেটেছিল। জরিমানা আদায় করতে মনুষত্যহীণ আচরণ বহু ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। 

আসামী পক্ষের উকিল জ্যোতির্ময় দাশগুপ্ত অ্যাডিসনাল জজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন – সম্প্রতি বাংলায় যাব না, বলে পুরুলিয়াতে যে তথাকথিত সত্যাগ্রহের অভিনয় করান হল, তাতে ঐ একই বি.এম.পি.ও -র ৯(৫) ধারায় একই ম্যাজিস্ট্রেট তথাকথিত আসামীদের আদালতে ওঠা পর্যন্ত সাজা দেওয়াই পর্যাপ্ত মনে করেছেন। অথচ এদিকে টুসু-সত্যাগ্রহীদের ঐ একই ধারায় এক বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাস সশ্রম কারাদন্ডর আদেশ দেওয়াকেও পর্যাপ্ত মনে করলেন না।

তখন অ্যাডিসনাল জজ জানান বিচার ম্যাজিস্ট্রেটের অভিরুচি।

আপীলের বিচারে এক দফায় অটল মাহাত এবং হেম মাহাতকে রেহাই দিয়ে অ্যাডিসনাল জজ বলেন রেহাই দেওয়া হল। কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে আবার নতুন মোকদ্দমা আনতে পারেন।

উকিল জ্যোতির্ময় দাশগুপ্ত, জগদীশ চ্যাটার্জী, সতীশচন্দ্র সাহা, প্রমোদকুমার ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, হরকালী মুখার্জীরা আসামীপক্ষের হয়ে সমর্থন করেন।

বিহারের জনসমর্থন আদায়ের মিথ্যাচার:

■■■■■■■■■■■■■■■■■

এবার বিহার সরকার নতুন চাল দিল। পুরুলিয়াকে বঙ্গভূক্তির বিরুদ্ধে জনমত সমর্থনের চেষ্টাতে হরতালের ডাক দিল। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি “মুক্তি” পত্রিকা থেকে জানা যায় এই হরতাল ব্যর্থ হয়েছিল। এবার পুলিশ পুরুলিয়ার সমস্ত বাস সার্ভিস বন্ধ করে দিল। গুন্ডা দিয়ে জনগণকে ভয় দেখাতে শুরু করলো। গুন্ডারা ঝালদা এবং চান্ডিলে বাঙালিদের সম্পত্তি লুঠ করলো। এই পরিস্থিতিতে অতুলচন্দ্র ঘোষ টেলিগ্রাম করে ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে  জওহরলাল নেহেরুকে সমস্ত জানালেন।

সার্বিক হরতাল ও অরন্ধন:

■■■■■■■■■■■■

বাংলাভাষী অঞ্চলের দাবীতে এবং কেন্দ্র সরকাারের আচরণের প্রতিবাদে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি পুরুলিয়ায় হরতাল পালন করলো লোকসেবক সংঘ। পালিত হল সমস্ত বাড়িতে অরন্ধন। শহরের রাসমেলা ময়দানে হল বিরাট জনসভা। পরিচালনা করলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ।

এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানালেন -পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারকে একত্র করে “পূর্বপ্রদেশ” নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হবে। বাংলার প্রবীন কংগ্রেসের নেতারা বিষয়টি মানতে চাইলো না।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে জনসভা:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

বিধান চন্দ্র রায়ের “পূর্বপ্রদেশ” গঠনের ঘোষণার পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে প্রতিবাদী সম্মেলন হল। সেই সম্মেলনে বক্তৃতা করলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, জননেতা জ্যোতি বসু, লেখক গোপাল হালদার, কাজী আবদুল ওদুদরা। 

টুসু সত্যাগ্রহের লং-মার্চ:

■■■■■■■■■■■

জামতারা গ্রামে ভাষা রক্ষার দাবিতে দশ হাজার মানুষ জড়ো হল। লোক সেবক সংঘের জেলা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বাংলা জুড়ে সত্যাগ্রহ পালিত হবে। 

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ‌। ২০ এপ্রিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি স্বর্ণময় দিন। দিনটা শুক্রবার। পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানা থেকে পাকবিড়র্যা গ্রামের থেকে শুরু হল ঐতিহাসিক পদযাত্রা। বঙ্গ সত্যাগ্রহ আন্দোলন‌। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবন্যপ্রভা দেবীর নেতৃত্বে ১,০০৫ জন মানুষ পায়ে হেঁটে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে চললো মিছিল। সবার হাতে সাদা রঙের ওপর সূর্য ও চরকা আঁকা পতাকা।

বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাত, চৈতন্য মাঝি, অরুণচন্দ্র ঘোষের পরিচালনায় গাইতে গাইতে চললো টুসু সত্যাগ্রহের দল। গাইলো রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান।

মিছিল যত এগিয়েছে দুধারে দাঁড়ানো মানুষ শাঁখ বাজিয়ে, মঙ্গল ধ্বনি করে, খাদ্য দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে সত্যাগ্রহীদের।

টানা ১৬ দিন ধরে এগিয়ে চলে মিছিল। বাঁকুড়া, বেলতোড়, সোনামুখি, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান,               রসুলপুর, মেমারি, পান্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, গোঁদলপাড়া, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, হাওড়া পেরিয়ে ৬ মে ১৯৫৬ র বিকেলবেলায় কলকাতা ময়দানে পৌঁছয়। ময়দানে হয় জনসভা।

৭ মে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ডালহৌসি স্কয়ারে ১৪৪ ধারা ভাঙেন। সত্যাগ্রহীদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর জেল, আলিপুর স্পেশাল জেলে।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকেন বিধান চন্দ্র রায়। বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

লোকসভায় বাংলা বিহার হস্তান্তর বিল পাশ:

■■■■■■■■■■■■■■■■■■■

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট লোকসভাতে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর বিল পাশ হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরুলিয়া সদরের ১৬ টি থানা এবং পূর্ণিয়ার কিছুটা ১ নভেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

থানা গুলি হল-

(১)ঝালদা : আয়তন ২২০বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১১৫৩৯৫ জন।

(২) জয়পুর: ৮৯ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪৩৭৬৪ জন।

(৩) পুরুলিয়া: ২১৬ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১৫৬০২৪ জন।

(৪) বলরামপুর: ১০৩ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৫১৬৯ জন।

(৫) হুড়া: ১৫২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৬২৬১২ জন।

(৬) আড়শা: ১০২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৭৩০২ জন।

(৭) পুঞ্চা: ২০১ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৫৭৫৪ জন।

(৮) বাঘমুন্ডি: ১৭২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫১১৮৪ জন।

(৯) বরাবাজার: ১৬০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৭৬৯৩৯ জন।

(১০) বান্দোয়ান: ১৪২ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪০০৭৬ জন।

(১১) মানবাজার: ২৫৭ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১২০৬৯৯ জন।

(১২) রঘুনাথপুর: ১৫১ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১০৫৮১২ জন।

(১৩) সাঁতুড়ি: ৭০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৩৩৭৫১ জন।

(১৪) নিতুরিয়া: ৮০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৪৬৫৯০ জন।

(১৫) কাশীপুর: ১৭৩ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৭৯৭৫২ জন।

(১৬) পাড়া: ১১৯ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৬৮৩০১ জন।

মোট ১৬ টি থানা। যার আয়তন মোট ২৪০৭ বর্গমাইল। মোট লোকসংখ্যা ১১৬৯০৯৭ জন।

এই অঞ্চলের বাইরে ছিল জাতীয় সড়কের পূর্বভাগ -এর কিষাণগঞ্জ মহকুমা এবং গোপালপুর অঞ্চলের ৬০০ বর্গমাইলের মত অঞ্চল।

এলো বিজয়ের দিন:

■■■■■■■■■

অবশেষে এলো  সেই পুন্য দিন |১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর |বাংলা ভাষার  উপর হিন্দী সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লড়াই-এর বিজয় দিন।

এই দিনকে স্মরণ করে কবি নরেন্দ্র দেব এবং কবিপত্নী রাধারাণী দেবী লিখলেন-

সুস্বাগতম

         ●●●●●●●●●●●

    ” বহু মানে আজ মানভূমে মোরা

                       এই শুভদিন নিলাম বরি’ ,

    ধন্য হলেন জননী আবার

                       হারানো তনয় বক্ষে ধরি |

   জয়গৌরবে এসেছে ফিরিয়া

                       সন্তান তার আপন গেহে ,

     ছিন্ন অঙ্গ দেশমাতৃকা

                        দেখা দিল পুনঃ পূর্ণদেহে |

    জানি, জানি যাহা রয়ে গেল বাকি

                  মাতৃভাষায় ঐক্যতীরে

    তোমাদের দৃঢ় সাধনার বলে

                   একদা তাহাও আসিবে ফিরে |

( “মুক্তি”পত্রিকায় প্রকাশিত/১৭শ বর্ষ/৪০ সংখ্যা/সম্পাদক-বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত )

মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারীরা:

■■■■■■■■■■■■■■■

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল  নারী শক্তি। মানভূম ,ধলভূমের আদিবাসী মেয়েরা থেকে শুরু করে লাবন্যপ্রভা দেবী, বাসন্তী দাশগুপ্ত(রায়), চাষির ঘরের মেয়ে ভাবিনী মাহাত, দধীরাম দাশগুপ্তের দুই মেয়ে- ডালু ও মনোরমা, পাঞ্চী সর্দারের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে ১৯৩১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চারবার জেল খেটেছেন লাবন্যপ্রভা দেবী, তখন তাঁর ঘরে চারটি ছোট্ট বাচ্চা। ভাষা আন্দোলনের মিছিলে কলকাতায় এসে আইন অমান্য করলে বিধান রায়ের সরকার তাঁকে এগারো দিন জেলে রাখে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জরুরী অবস্থার সময় কলম ধরে সরকারের সমালোচনা করেও গ্রেপ্তার হন তিনি। আর এই কারণেই তাঁকে ডাকা হয় মানভূম-জননী নামে।

ভাষা বিজয় কি প্রাপ্য সম্মান পেল?

■■■■■■■■■■■■■■■■■

১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত চলেছিল মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন। মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন হলেও এর মূলটা ছিল নিহিত ভাষার বিভাজনে। আন্দোলনের সূত্রপাত এবং সংগঠনের মূলে ছিলো ভাষার আন্দোলন।

বাংলাদেশের ভাষার আন্দোলন যে চেতনার বীজ রোপন করেছিল মহান মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটেছিল।

পক্ষান্তরে মানভূমের ভাষার আন্দোলনের পরিণতিতে মানভূমের পূর্বাংশকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যে সমাপ্ত হয়। মানভূমের ভাষার লড়াইয়ে কাউকে হয়তো প্রাণ দিতে হয়নি। তবে নয় বছর ধরে চলা আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষকে নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। মানভূমের বাংলা ভাষার জন্য লড়াই শুধু মাত্র মানভূমবাসীর গৌরব নয়, এ গৌরব পৃথিবীর সমস্ত বাঙালির।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আন্দোলনের ইতিহাস আজ মানুষ প্রায় ভুলে গেছে। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাকবিড়াতে ভাষা স্মারক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবের মুখ দেখেনি।স

মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে সরকারী বা বেসরকারী বিজয় উৎসব প্রায় হয়না।

পুরুলিয়ার সিধু-কানহু-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে যদিও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ্য হয়েছ। কিন্তু এই ইতিহাস বাংলার সামগ্রিক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যলয়ে পাঠ্য হওয়া উচিত।

বারে বারে আক্রমন বাংলা ভাষাকেই:

■■■■■■■■■■■■■■■■■

বাংলাই মনে হয় সেই ভাষা বা একমাত্র ভাষা যে ভাষার অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হয়েছে অখন্ড বাংলার পশ্চিম সীমান্তের মানভূম থেকে পূর্ব সীমান্তের বরাক পর্যন্ত।

বাঙালিকে অত্যাচার ,নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর। পৃথিবীর আর কোন ভাষার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।

আজকে আসামে এন.আর.সি-র নাম করে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাগরীকত্বের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল, তার সিংহ ভাগই বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষীক মানুষকে এন.আর.সি-র ভয় দেখাচ্ছে হিন্দী সন্ত্রাসবাদীরা। ত্রিপুরা, মেঘালয়, ঝাড়খন্ডের বাঙালিরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আর সেই জন্যই প্রতি বছর ১ নভেম্বর বিশ্বের প্রতিটি বাঙালির ভাষাকে নিয়ে শপথ নেবার পুন্য একটি দিন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯ মে , ১ নভেম্বর বাঙালির ভাষা নিয়ে তিনটি তারিখ শুধু নয়। তিনটি জাগরণের দিন। জেগে ওঠার দিন।

তথ্য ঋণ্:

■■■■■■

(১)  BENGAL DISTRICT GAZETTERERS -MANBHUM. H  COUPLAND,BENGAL SECRETARIAL BOOK DEPOT,1911

(২)  টুসুর গানে মানভূম/সম্পাদনা-অরুণচন্দ্র ঘোষ।

(৩)ভাষা স্মারক অর্ধ -সমাপ্তই, অবহেলায় ছড়াচ্ছে ক্ষোভ/সমীর দত্ত/আনন্দবাজার /২০১৫ ।

(৪)  ভাষা আন্দোলন দেশে দেশে/উত্তম কুমার রায়/ পরিবর্তন/ ২০১৭ ।

(৫)  টুসু/ড. শান্তি সিংহ /লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ /পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

( ৬ )  কোরক সাহিত্য পত্রিকা/বাংলা ভাষা সংখ্যা/শারদীয়া ১৪১০ ।

( ৭ )  পশ্চিমবঙ্গ /পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা/জুন২০০৭ ।

(  ৮  )  রক্তে- ভাষা মাতৃভাষা /সম্পাদনা -নির্মলেন্দু শাখারু এবং জীবনকুমার সরকার/রিডার্স সার্ভিস/৫৯/৫ এ, গড়ফা মেন রোড/কলকাতা – ৭০০০৭৫ ।

(  ৯  )  বাংলা লোকসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপাদান/ ড. রবীন্দ্রনাথ শাসমল/ইউনাইটেড বুক এজেন্সি/টি-৩১ / বি, কলেজ রো /কলকাতা-৭০০০০৯ ।

(  ১০  )  অনৃজু/মানভূম লোকসংস্কৃতির  মুখপত্র/২৫ তম বর্ষ/শারদ সংখ্যা/১৪১৭ বঙ্গাব্দ ।

                       ●●●●●●●●●●

গুচ্ছ কবিতা:

বিকাশ চন্দ

~~~~~~~~~~~~~~~~

অচেনা দুঃখের আর্তনাদ

———————————-

অতটা জীর্ণ নয় অক্ষর মালা যতটা হাড় জিরজিরে আমি,

তবুও অক্ষরগুলি হাতে এলে কেমন প্রতিমা হয়ে যায়—

এ ভাবেই রাতগুলো অন্ধকার টেনে আনে চোখে, 

দেখতে পাই অক্ষরগুলো জোনাকি চন্দ্রাতপ—-

কাছে দূরে অনেকেই ঘিরে ধরে ফুলের নরম পাঁপড়ি। 

দীর্ঘশ্বাস নিলে ঘ্রাণে আসে নতুন ধানের গন্ধ হেমন্ত হাওয়া

কিছু চেনা অচেনা সুগন্ধী ফুলেদের বন বাতাসী খেলা, 

সকল বদলের গর্হিত চিহ্ন বোঝে গাছের শরীর —

মানুষতো উন্মোচিত প্রগাঢ় কেতাদুরস্ত বিষয় বাসনা বোধে

শ্রীময়ী সংকেতে কত ভাষালাপ নিষিদ্ধ সময়ে বাতাসে ভাসে।    

দেশান্তরি মানুষের মতো পাখিদের ও ভাষা আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে

কিছু ভাষা ভেসে আসে ভেজা দৃষ্টি পথে চোখের পাঁপড়ি ফুলে,

বন জানে সমস্ত বসন্ত কথা কৃষি ভূমি নীরব উর্বরা শিকড়ের টান—

অচেনা উচ্চারণে ভেসে আছে রাতের নক্ষত্র দিনে ফুলে মৌমাছি গান,

নিঃশব্দে মানুষের ভেতর জমে থাকে তবু অচেনা দুঃখের আর্তনাদ। 

ভাষা অভিমান

——————–

অক্ষর শব্দ বর্ণমালা বোঝে না স্বাধীনতা

তবুও বুঝে ছিল মুক্তপ্রাণ দোয়েল পাখির ডাক

মোটা ভাত কাপড় আর নিজস্ব ভাষা

মুক্ত মন মানেতো অনুক্ত অধিকার কথা

সমস্ত জলের রঙ স্বাদ এক

দেশ কাল মাটি গড়ে ভাষার শরীর

এখন বিমুক্ত পদ্মা মেঘনা গঙ্গার টানে

সীমা রেখা বার বার সীমান্তে ডাকে

শাপলা শালুক জানে বুকের শব্দ মালা

অক্ষর হৃদয় খুঁড়ে বারবার ফিরে আসে

একুশে ফেব্রুয়ারি আর ঊনিশে মে। 

মুক্তমনা ব্লগার এসব জানে তবু মৃত্যু ডাকে

কোথাও কি দ্বন্দ্ব আছে অন্ধ রাতের ভেতর

আমার ভাষার অন্তর্গত প্রাণের সংলাপ

ধর্মান্ধ কুয়াশা এখন সীমান্ত পারাপার

হায় ভাষা সংগ্রাম নিজস্ব চেতনা বিলাপ

স্বাধীনতা বোঝেনি গোপন মৃত্যু

দুয়ারে আঁচল ছড়িয়ে দুয়ার আগলে মা

বাছারা ফিরে আসবে রক্তে ঘামে ভিজে 

কান্নার ও শব্দ আছে ভাষা তা কি বোঝে ? 

প্রেম প্রীতি ভালোবাসা কুণ্ডলী পাকায় আনাড়ি

ওই দেখ ওখানে সারিবদ্ধ আসন পাতা

হৃদয় পেতেছে হাত বর্ণাক্ষরা উবুড় করেছে প্রাণ

ওখানেই এক হয়েছে জমিন আসমান

বাংলা আমার চতুর্পার্শ্বে ভাষা-অভিমান। 

আরাধ্য ঈশ্বর যদি

————————-

জলের ভেতর জলের শব্দ কলস্বরা জানলো সবাই

বৃষ্টি নাচে আপন খেয়ালে পাতায় নাচে আলোর সবুজ   

অক্ষর দ্যোতনা অসংখ্য অন্ধকারের বলয়ে মুক্তা আলো

নিরক্ষর  লানছনা দেখেছে বর্ণহীন যত ভাষা বোধ

বিষণ্ণ ছায়া ভেঙে আসে আমাদের প্রিয় ভাষা মুখ। 

জীবনের অনন্ত ভাবনায় জেগে ঈশ্বর আলো

অক্ষর ঘরে বর্ণমালায় লতায় পাতায় বর্ণময় ফুল

অবলুপ্ত তবুও অন্ধকার ভাঙে প্রতিদিন প্রাণের কিরণ

ফেলে আসা বহুকাল তবু আগলে অন্তর আকর

লোভ লজ্জায় অধুনা জন্ম কেনো যে ভাস্বর

অকারণ আঁচড়ে ক্ষত মানব হৃদয় 

ঈশ্বর তবু দয়ার সাগর। 

প্রাণে প্রাণ হৃদয়ের দু’পাশে জ্বলেছে রক্ত বাতি

সুন্দর সে দেহ মন কতবার পেরোবে প্রশান্ত শতাব্দী

নিভৃত কুটিরের ভেতর কথা শব্দ ভাসে জল পড়ে পাতা নড়ে   

সকল সুবোধ বালক হয়ে ওঠে গোপাল 

আদুরে মাসীর কান আর কাটেনি যত চোর ভুবনেরা   

অকাল বৈধব্যদশা নেই অনূঢ়া ধর্ষণ যত বীভৎসতা

হায় !  এসব দেখেছিলেন আরাধ্য ঈশ্বর যদি ! 

____________________________________

আবদুস সালাম

~~~~~~~~~~~~~~~~

তীর্থ ক্ষেত্র

————————-

ভোরের আকাশ খুলে গেলে  ভেসে আসে সংকেত

সমুদ্রোপকুল ভেঙে জন্ম নেয় মেঘ

সকাল হলেই দেখি  কিভাবে বৃষ্টি নেমে আসছে বর্ণমালার আকাশে

সেদিন মৃত্যু  ডানা মেলেছিল মেডিকেল চত্বরে

পরাজয় নেমে এসেছিল পাড়ামহল্লায়

বিভেদ মেতেছিল সংকটের সীমানায়

পলাশের রং লেগেছিল  ভাষার তীর্থক্ষেত্রে

 মাতৃভাষার বাঁশি বেজেছিল পৃথিবীর বনে

ময়ূর নেচেছিল হৃদয়ের ঘরে

 অদূরে কৃষ্ঞ বাঁশি বাজিয়ে ছিল  সেই সুরে

 ঘুড়ি রঙের হৃদয় উড়ছে আন্তর্জাতিক বলয়ে

 আজ সব তীর্থক্ষেত্র  উল্লাসে মাতোয়ারা

আমার ভাষা

————————-

এখনো অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে ঘুরে আসে

রোজ দেখতে পায় দিন বদলের কানামাছি খেলা

পলাশ বনে উঁকি মারে রক্তাক্ত অভিসার

ভাষার আফিম খেয়ে নাচে কৃষক মজুর

ভাটিয়ালীর সুরে পূজা হয় বাঙলা মায়ের

ভাষার সন্তানেরা  রোদ জলে ভিজে

ভাষালুটেরা গুলি চালায় নির্বিচারে

আবেগের পাখিরা ডানা ঝাপটায়

রোদ জমা হয় আলোর প্রান্তরে

ভাষার নগ্নডানায় জড়ো হয় অমানবিক -ক্ষত

কুটিল আবর্তে পাক খায় ভ্রষ্ট বিবেক

সারা পৃথিবীর মুখে   মাখালো চুনকালি 

নিকানো  উঠোনে পুঁতে দিচ্ছি ভাষার- ফনিমনসা

লালন করছি যতনে

ভাষার কাঁটা গাছে নাকি খাদ্য শষ্য ফলে

মাতৃভাষা

————————-

ভাষা নিয়ে বেহায়াপনা ভাল্লাগেনা

স্তব্ধ চিৎকার ভেসে আসে

চুঁইয়ে পড়ে ভালোবাসার গান

আলোচ‍্য উচ্চারণে জমে ওঠে মেঘস্তব্ধতা

খুলে ফেলি বিদগ্ধ নিষেধাজ্ঞা

পল্লবীত সাঁতরে হাবুডুবু খায় মাতৃভাষা

পৃথিবীর মন্দিরে মন্দির বাজে কাঁসরের ঘণ্টা

মাতৃভাষার পূজা হয় পাগলের প্রলাপে

অর্ধোন্মাদ মানুষ আর্তনাদ বিদেশী ভাষায়

ভালোবাসার ভাষা কাশবনের মাথায় দুঃখের কুঁড়ে  মুখ গুঁজে 

____________________________________

 বাংলা ভাষার জন্য

 সমর ভূষণ দে

হঠাৎ স্টেশনটা জেগে উঠলো

অসংখ্য কণ্ঠস্বরে শিলচরে

বাংলা ভাষা বাঁচানোর দৃপ্ত স্লোগানে

কটমট চোখে অসম পুলিশ

রাষ্ট্রীয় সৈন্য চালালো বুলেট

ভব্যতার সীমা পেরিয়ে

সভ্য জগতের মরুভূমিতে সেদিন লুটিয়ে পড়ল

কানাই সুনীল হিতেশ তরণী কমলা

অগণিত মানুষের চোখে প্রতিবাদের ভাষা

বোমার মত ফেটে পড়ল

অসহায় মানুষ দেখলো

বাংলা ভাষা চর্চার অধিকার রক্ষার পরিণতিতে

হিংসার রক্ত

জাতিগত বিদ্বেষ

নেশন্ ভায়োলেন্স

ক্ষতবিক্ষত ডেমোক্রেসি

সন্ ঊনিশ’শ একষট্টি 

কত মৃত্যু

কেঁদে ওঠে শঙ্খ

বড় বড় গাছের ছায়া গম্ভীর

রবীন্দ্রনাথ যেন চেঁচিয়ে বললেন,

বাঙালির রক্তে বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা…..

____________________________________

মাতৃভাষা

দেবাশিস মিশ্র

তার জন্যেই ছাড়তে পারি একশো তালুক,

উথালপাথাল মনের কোণায়

সাতরঙা প্রেম মগ্ন থাকুক, 

স্বপ্ন মাখুক;

তারই, কেবল তারই মায়ায়

স্নেহচ্ছায়ায় ভরব মুলুক।

আহ্বানে তার ভরতে পারি আপন মুলুক,

জীবনভরের দুঃখ-ব্যথায়

একান্ত এক ভরসা থাকুক,

শান্তি জাগুক,

জড়ায় তাকেই আজ কবিতায়

দুঃখচিতায় ঝলসানো বুক।

সেই সু-ভাষার ছোঁয়ায় জাগে বিষণ্ণ বুক,

স্বেদ-শোণিতে তৈরী পাতায়

ঠাঁই করে নেয় বিপন্ন সুখ,

কিংবা অসুখ;

সেই সরোবর তোমায় আমায়

আজও জোগায় পদ্ম-শালুক।

____________________________________

   মাতৃভাষা

রতন কুমার নাথ

বাংলা আমার মায়ের মুখের ছোট্ট তোতাপাখি

বাংলা আমার বোনের হাতের লাল টুকটুক আঁখি। 

বাংলা আমার কবিগুরুর শুক্রবারের হাট

বাংলা আমার প্রথম বন্ধু মিষ্টি সহজপাঠ। 

বাংলা আমার দাদুর ছড়া, মায়ের পিঠেপুলি, 

বাংলা আমার ভায়ের মুখের আধফোটা সব বুলি। 

বাংলা আমার দোলের খেলা, চোত-ফাগুনের গান        

বাংলা আমার মাসিপিসির গল্প অফুরান। 

বাংলা আমার কাঁসর-ঘণ্টা, সান্ধ্য আজানধ্বনি

বাংলা আমার দরবেশ গান, উমার আগমনি। 

বাংলা আমার বুকের বেদন, জল ছলছল আঁখি

বাংলা আমার মায়ের মুখের ছোট্ট তোতাপাখি। 

____________________________________

দহন  কালের  নিজস্ব কথামালা

        বিরথ  চন্দ্র মণ্ডল

সীমাহীন  অলস সময়ে  কেটে যায়  রাত্রি-দূপুর, 

কতদিন প্রহর  গুনবে  প্রিয় কথা সব…… 

শায়ন্তনী ;আর কতদিন  হামুখ   জানালায় 

লেপ্টে থাকবে সপ্নিল  দু’চোখ….. 

এ পাথর সময়ে ফড়িং বিকেল  হয়ে ধুসর কুয়াশার  বুকে এসো  । 

দ্যাখো ;ঘরকন্যায় মেতে যাবে  চড়ুই উঠুন . …..! 

জল জানি গড়ায় নীচের দিকে  

ইদানীং জলেরা ভুলে গ্যাছে ধর্ম বোধ  

সবার নিঃশ্বাসে করোনা আবহ  

বৃক্ষ শিশুর  চোখে  ঘুম নেই  

কতদিন  পাতিঘাস ও রোদ্দুর দ্যাখেন। 

যদি  প্রিয়কেই  ভালোবাসো… প্রকল্পিত  প্রাচীর ভাঙ্গি এসো  … তার পর  চিলের ডানা মেলে ডেকে নিও “তোমার  আমাকে “।

___________________________________

ভাষা শহিদ স্মরণে

তপন কুমার রায়

যে ভাষাতে বলব কথা

তোমার সাথে ভালোবেসে

সেই ভাষাটিই কেড়ে নিলে

আঁধার নামে এক নিমেষে।

বাংলা ভাষার জন্যে লড়াই

করল কত ভাষা প্রেমিক

তাদের কথা ক’জন জানে

 মরল যারা‌ গুলি খেয়ে।

আজো যেন বলছে তারা

বাংলা মাকে ভালবাসি

বাংলা আমার মাতৃভাষা

তোমার আমার সবার ভাষা

১  নভেম্বর শ্রদ্ধা জানাই

ভাষার জন্যে শহিদ যারা।

পুস্প মাল্যে প্রদীপ জ্বেলে

স্মরণ করি ভাষা স্তম্ভে ।

____________________________________

মাতৃভাষা

প্রণব ঘোষ

আমার সামনে বসে আছে যে মেয়েটি ও একুশে

যার শরীর থেকে গন্ধ ভাসছে সোঁদা সোঁদা

যা আমার শরীর এবং হৃদয়ে মিশে গল্প শোনায় লাল মাটির

আমি যাকে ভালোবাসি

যে নদীটা প্রতিনিয়ত বাঁক নিচ্ছে আর ভাঙছে

আমি সেই ভাঙন পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তার

শরীরের গন্ধ শুঁকছি আর আমার রক্ত-মাটিমাখা হাত

ছুঁয়ে রাখে আমার মাকে।

আমার সামনে বসে আছে যে মেয়েটি বাঙাল ঘোমটায়

ওই মেয়েটি মাতৃভাষা।

____________________________________

চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যা

মনোতোষ আচার্যের গুচ্ছকবিতা   আলোর ফোটন খুঁজে যে আলো মৃত্যুর দূত, যে আলোতে অপমৃত্যু বোনা  কেন তবে দরজা খুলে সাজিয়েছি আবাহন ঘট   জাতকের জন্য খুঁজি আলোর ফোটন… পৃথিবীর বন প্রান্তরে   অন্তহীন প্রাণদ সাগরে সাঁতরে কাটাবো কালবেলা মিশে গিয়ে শমদায়ী সোনালি ফসলে  আন্তর কালিতে লিখি লগ্নভ্রষ্ট  আগামীর চিঠি…  বর্ষার প্রদোষে কেউ তুলে নেবে অশ্রুভেজা চোখের ফলকে  পরিত্যক্ত […]

চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যা

চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যা

মনোতোষ আচার্যের গুচ্ছকবিতা  

আলোর ফোটন খুঁজে

যে আলো মৃত্যুর দূত, যে আলোতে অপমৃত্যু বোনা 

কেন তবে দরজা খুলে সাজিয়েছি আবাহন ঘট  

জাতকের জন্য খুঁজি আলোর ফোটন… পৃথিবীর বন প্রান্তরে 

 অন্তহীন প্রাণদ সাগরে সাঁতরে কাটাবো কালবেলা

মিশে গিয়ে শমদায়ী সোনালি ফসলে 

আন্তর কালিতে লিখি লগ্নভ্রষ্ট  আগামীর চিঠি… 

বর্ষার প্রদোষে কেউ তুলে নেবে অশ্রুভেজা চোখের ফলকে 

পরিত্যক্ত আমলকী বন শিউরে উঠবে

ঘন ঘন ব্যাঙেদের আর্তনাদে।

সময়ের উগরানো বিষ মুছে 

হেঁটে তুমি পেরোবেই অন্ধকার সাঁকো…        

ভিক্ষাব্রত

দাতা তুমি ভগবান — এলাম তোমার দ্বারে

ভিক্ষাব্রত, সংঘ গড়ে রক্তদান সেবা

তুমি ফিরিয়ে দিচ্ছো — অপবাদ উপহার দিচ্ছো

এই তো প্রাপ্য, শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি

মাদ্রাজ থেকে এলো চিঠি

প্রসন্ন দৃষ্টির সন্ন্যাস… দূরাগত ধ্বনি ভাসে কানে

চিন্ময় ঔদার্য, কীর্তি সুমহান,প্রেরণা মহৎ

তুমি দ্বারে দ্বারে পাঠিয়েছো

সম্মিলিত চেষ্টার আকর সন্ধানে।    

ভূর্জপত্র

  

না বলা কথার বাঁকে পেকে ওঠে যন্ত্রণার মেদ 

দু’একটি স্মৃতির দিশা পথ দেখায় জানি

তবু মেঘলি রোদের তাপে দেহলি আবেগ যায় পুড়ে

হে তমোনাশ, কৃপাবদ্ধ পাথুরে আবেগ

দূরত্বের সঘন আবেগে জ্বলে ওঠো

দিব্যবাহুর মূলে বাঁধা আছে 

ভূর্জপত্রে আবশ্যক রক্ষা-শর্তগুলি…  

তিতুমীর

সেজে ওঠা ভালোবাসাগুলি চাঁদ চায়

পোশাকি গল্পের মতো ব্যক্তিগত অধিকার মেপে নেয়

শোষকের জরিপকাঠি —খোড়ো চালে সূর্য উঁকি দেয়

বাঁশঝাড়ে তিতুমীর, লালকাঁকর — রক্তের দাগ

গিরিজন গুহার আড়ালে শস্য ও জ্যোৎস্না লুটপাট

হারানো স্বপ্নের ঘাটে পা ডোবায় প্রতিশ্রুতি 

আগুন পাখির গান জমে আছে পাতায় পাতায়…     

——————————————————————————————————————————               

পৌষালী চক্রবর্তী 

অস্তিত্ব

ছাদের আলসেতে আলগোছে ঝুলে থাকা ঘুড়ির মত

লেপ্টে আছে জীবন।

এমন অসময়ে আমরা জল পাইনি একটুও

শুধু দুপুর গড়ানো 

কিছু ফুলের অস্তিত্ব দেখে 

ভেবে গেছি সারা পৃথিবীইছিল 

ঘরবাঁধার জন্য।

তবু আমরা জায়গা পেলাম

 আলসে টুকুতেই।

জীবন

আলতো হাতে ছাড়িয়ে নিচ্ছি চামড়া,মাংস,মেদ ,মজ্জা

জীবনের থেকে।

ওজন করব বলে।

একহাতে পালক লাগে অন্য হাত 

পাথরের মত ভারী ।

এই তো জীবন।

খণ্ড খণ্ড নিয়ে ডিঙ্গা ভাসনোর

পলকে কাজল হয়

অপলকে নষ্ট চোখ।

——————————————————————————————————————————-

শুভ্রাশ্রী মাইতি।

স্পর্শ।

শরীরে শরীরে ঘষামাজা শেষ হলেই দুটো শরীর নিঃশব্দে সরে যায় বিছানার দুদিকে।

মাঝে দূরত্বের আলোকবর্ষ মাপে স্পর্শকাতর রাত।

শরীরের ওপর শরীর সাজানো যত সহজ।

 হাতের ওপর হাত রাখা তত সহজ নয়।

স্পর্শপদাবলীর এই সহজ সূত্রটা সহজ ভাবে বুঝতে পারে না বলেই

মন ছোঁয়ার আগে শরীর ছোঁয়ার হুড়োহুড়ি ব্যস্ততায়

বেশিরভাগ দাম্পত্যই বিছানার নাবালকত্ব কাটিয়ে 

সাবালক হয়ে উঠতে পারে না স্বাভাবিক নিয়মে।

বিষাদসিন্ধু।

ঘন দুধের ওপর পালকের মতো ভেসে বেড়ানো 

চিকন সরের সুখগুলোকে আলাদা করে

দুঃখটাকে সযত্নে ঢেলে রেখেছি লুকানো হৃদয়পাত্রে।

দুঃখ জমতে জমতে বুকের জমিটা লোনা হয়ে উঠলে

ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে নামে বিষাদের তরল ধারা।

ঠোঁটের গোলাপবাগান ভিজিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে

শরীরের উত্তুঙ্গ চূড়া,গভীর গিরিখাত আর নরম তৃণভূমি।

শরীর জুড়ে জমে ওঠে ভালবাসার নরম,উর্বর পলিস্তর।

দুচোখের পাতায় সোনারঙা ফসলের স্বপ্ন আবেশ। 

অবিশ্রান্ত বিষাদ ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে 

আমি নিজেই কখন হয়ে উঠি এক আশ্চর্য বিষাদসিন্ধু।

——————————————————————————————————————————

মনীষা কর বাগচী

ফুল ফোটাই

তুমি আমি আমরা সবাই ফুল ফোটাই জীবন বাগে

     আশায় আশায় থাকি বসে

      উন্নত শির কাব্য রসে

     সৌম্য তপন সকাল আনে

     ভালোবাসতে আকাশ জানে

দিন চলে যায় একা আমি ডুবে থাকি পূর্বরাগে।

——————————————————————————————————————————

আবদুস সালাম

অভিমান পুষে রাখি

  ম্রিয়মাণ সম্পর্ক গুলো আলগা হয়

ঠিকানা হারানো পথে ফেলে রাখি আলিঙ্গন

শব্দেরা কোলাহলে  মত্ত

অভিমান বাসা বাঁধে চেতনার ঘ‍রে

দূরের বিকেলে ঘুঘু ডাকে বলে কুমারী মা হয়

চরাচর ভেসে যায় কলঙ্কের বন‍্যায়

একেকটা প্রতারিত দিন নিঃশব্দে ঘুমায়

ধর্ম পোকারা সুড়সুড়ি দেয়

জেগে ওঠে ধর্মান্ধ মানুষ, শান দেয় তরবারিতে

——————————————————————————————————————————-

তপন তরফদার

নষ্ট প্রেম

প্রেমের স্বাদ যে আমাকে শিখিয়েছে

যাবতীয় নরম জ্যোৎস্নার বৃষ্টি ধোয়া শরীরী

রিমঝিমের শব্দের ভালবাসা দিয়েছে খোলাচুলে

আমি অঙ্ক কষে তাকে দিয়েছি বোনোজল।

রূপোর মত চকচকে আভরণের স্পর্শে

আমি মগ্ন হয়েছি পাহাড়ি ঝোরার স্রোতে

অসতর্ক চরাচরে সতর্ক দাঁড়ি না টেনে

যখন তখন কমা- সেমিকোলনে ডুবে গেছি

পাতালের অতল থেকে রসাতলের ঠিকানায়।।

——————————————————————————————————————————

হরিশঙ্কর কুন্ডু

নীরবতা

এইভাবে ক্ষয়ে যায় অনাহুত চাঁদ

শিশিরেই ভিজে গেছে মাটি আর ঘাস

বুকের কান্না শোষে মরিচীকা ফাঁদ

তবু এই বিছিন্ন দ্বীপে পরবাস

এইভাবে আদিমতার নিসংশতা মেখে

তোমার শরীর কোথাও কামিনীর ফুল

কিছু ঋণ ভালোবেসে বন্ধক রেখে

আমি করি প্রত্যাশা সেকি শুধু ভুল

এইভাবে হারিয়েছে অগণিত ঢেউ

রাতের যাপন ভোলে প্রতিশ্রুতি কথা

তৃপ্তির সুখ মেটায় সাময়িক কেউ

অসহায় রাত্রি আমার জাগায় নীরবতা

————————————————————————————–

amazon products

click here to buy this products women’s kurti

add

চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকার ২য় ই-সংখ্যা

 

——————————————————————————————————————————-

কবি পরিচিতি -ঃ       সন্দীপন দাস

 জন্ম-১০ই মে,১৯৯৩

জন্মস্থান-বনগাঁ জীবনরতন ধর মহাকুমা হাসপাতাল

প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়-‘বনলতা’ সাহিত্য পত্রিকায় ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ১৪ বছর বয়সে বনগাঁ থেকে।

এখনও পর্যন্ত কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিতব্য-বনলতা পত্রিকা ও প্রকাশন।

সম্পাদক-‘বিবেকের আলোকে’ সাহিত্যপত্র।

অজস্র পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি চলছে।

প্রিয় কবি-জীবনানন্দ দাশ

ভালোবাসি-পাহাড়, সমুদ্র।

শখ- পুরোনো চিঠি পড়া

ইংরেজি ভাষায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে বি.এড.পাঠরত।

              ফিসপ্লেট

১.

পোর্সেলিন পাত্রে জমানো ঈর্ষা দ্রুত ঠান্ডা হচ্ছে

তুমি না বুঝেই তা ঢেলে দিচ্ছো বাসরুটের ক্ষতজুড়ে…

এভাবেই বুঝি পার হয়ে যাওয়া যায় একটা হায়ারোগ্লিফ…

২.

হেমলক বনে মাঝরাতে কারা যেন ফেলে রেখে গ্যাছে ভ্রুণের মৃত্যু

রক্ত মুছে আবারও আড়ালে বুঝি বড়ো হতে চেয়েছেন এক খ্রিষ্ট

আবলুশ কাঠের টেবিলের পায়া জুড়ে সোহাগী ঘুম নামছে…

৩.

জাদুজানলা থেকে সাতরঙা আলো ঠিকরে এসে পড়েছে তোমার শরীরে

তুমি আগুনের ঠিকানা ভুলে জড়িয়ে ধরেছো আলোর অভিমান, মায়াবী ঈশারা

মনকেমন জাদুকর বৃষ্টি আনতে তখন একটানা বাজিয়ে চলেছেন বিষণ্ণ ম্যান্ডোলিন…

৪.

তুমি আলো নয়, মৃত্যুটুকু নাও

হেমলক বনে ফিরে যাবে ঝাঁক ঝাঁক সমান্তরাল প্রজাপতি…

বারচের শরীর ফুঁড়ে আবারও উঠে আসবে গোপন মন্ত্রের ছল-চাতুরী…

ভুল করে তুমি বুঝে নেবে আমরা সবাই টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির ফোকস্…

                      ফেরারী

 আর এভাবেই তুমি পার হয়ে যাচ্ছো সমস্ত কাঁটাতার

শহরের ঘুম,মৌর্য সম্রাটের সমস্ত অহংও…

একটা পাখি উড়ে গ্যালো তোমার শরীর ছুঁয়ে

আর রেখে গ্যালো এক অদ্ভুত আলো…

যে আলো ছুঁয়ে একে একে ঘুমিয়ে পড়ছে রাহী, অসহায় অশ্বমেধের ঘোড়া, শূন্যতার অস্থিরতা…

ঘুমিয়ে পড়ছে সন্ধেমণি ফুলের আত্মহত্যা, পর্ণমোচী আঙুলের ফুরিয়ে আসাও…

শুধু জেগে থাকছেন এক মানুষবেশী ঈশ্বর

যিনি নিশ্চিন্তে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন শহরের ঘুম থেকে এত এত আলোর সাম্রাজ্য জুড়ে…

তোমার গায়ের গন্ধ আবারও টুপটাপ ঝরে পড়ছে আমার কবিতায়…

আর এভাবেই তুমি পার হয়ে যাচ্ছো আমায়

আমার ঈর্ষাকে… নির্মিত সব ছল-চাতুরীও…

        দ্য ইউক্যালিপটা   

দূরে দাঁড়িয়ে শুন্যতা, কিছু না পাওয়া…

হাওয়ায় ভাসে সন্ধেমণি ফুল, রঙিন ফিতে

বাঁশি বাজাতে বাজাতে যে মেয়েটি এখন চলে যাচ্ছে

বাঁশবেণীর জঙ্গলে সে জানে শুন্যতার আর এক নাম বেঁচে থাকা

না পাওয়ার আর এক পিঠ হলুদ…

কবি আর কবিতা বমিকে টিকিয়ে রাখার এক অনাবিল প্রয়াস মাত্র…

সন্ধে গাঢ় হয়… আরও গাঢ় হয়…

আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বোনে আনমনা ইউক্যালিপটাস

পাতা খসে যায় একের পর এক…

একের পর এক…

দূরে দাঁড়িয়ে শুন্যতা, শামুকজন্ম, কিছু অভিমান…

——————————————————————————————————————————-

কবি পরিচিতি -ঃ  অর্ঘ্য দে

 জন্ম ১৯৮৩, বৈশাখ।

নিবাস : চুঁচুড়া, হুগলি।

পেশা: ফিজিওথেরাপি।

লেখালেখির শুরু কলেজজীবন থেকে। কলেজ ম্যাগাজিনে। কবিতাচর্চার শুরু ২০১৪ থেকে। কবিতা ছাড়া ছোটোদের জন্য লিটিল ম্যাগে লিখেছি কিছু ছোটোগল্প।  গিলগামেশ প্রকাশনী থেকে কলকাতা বইমেলা ২০১৯ এ প্রকাশিত হয়  প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটি থ্রিলার গল্প সংকলন ‘মৃত্যুর কোড’।২০২০ সালে বর্ধমান লিটিল ম্যাগ মেলায় আলপৃথিবী থেকে প্রকাশিত হয় একফার্মার কাব্যপুস্তিকা – ‘ডিসেম্বরের বাজনা’

হায়াত মিঞার ঋতুযাপন

এক

বৈশাখী ঝড়ের পর

লোডশেডিংয়ের নিকষ সন্ধ্যায়

আসত হায়াত মিঞা, পিঠে ঝোলা

আমরা আলো লুটে নিতাম খুশি মতো।

দুই

বর্ষা এলেই

জলফড়িংয়ের সবুজ মেখে

জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যেত হায়াত মিঞা

ভাসিয়ে দিতাম খেয়াল।

তিন

কখনও কখনও হায়াত মিঞাকে

কাশফুল মনে হয় – কোজাগরী রাতে

হাওয়া মেখে তিরতির কাঁপে,

আমার শরীরে ফোটে আলপনা।  

চার

হায়াত মিঞার এসরাজে

শুনি আজানের সুর,

হেমন্তের ফুরন্ত বিকেলে

হিমেল পাখিরা ফিরে আসে

আমার ঘরের আলোছায়ায়।

পাঁচ

উত্তর-বাতাসে কুঞ্চিত জনপদ ―

হামেশাই ভুলে যায় জীবনের উষ্ণতা

হায়াত মিঞা রুটি স্যে‍ঁকে,

গনগনে আঁচে

ফের আগুনের ব্যবহার শিখি। 

ছয়

বুকে দাউদাউ নিদাঘ,

কাঠকয়লার দেয়ালে

হায়াত মিঞা আঁকে

কৃষ্ণচূড়ার ছবি: বসন্তের সম্মোহন।

———————————————————————

 কবি পরিচিতি-ঃ দেবার্ঘ সেন

    নান্দনিকতা জীবনের প্রতিটি ছত্রে। শিল্পের জন্য যে কোন ত্যাগ শিরোধার্য করে থাকেন। দৈনন্দিন জীবনে লেখক এবং ম্যাথর দুই-ই। শুধু নারী নয়,পুরুষদের মধ্যেও মাতৃত্ব বপন এবং লালন করতে চান। ভীষণ খুঁতখুঁতে, অন্তত শিল্পের ক্ষেত্রে। সহজে সন্তুষ্ট হন না, হয়তো শিল্পেরই তাগিদে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন আর মাঝে মাঝে ছক ভাঙা ছবি আঁকেন। এখনও পর্যন্ত এককভাবে চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, যথাক্রমে সমান্তরাল( দিগন্ত প্রকাশন ২০১৮), এক্সকিউজ মি ( বার্তা প্রকাশন, বর্ষা, ২০১৮) কাজল বাঁশী ( বার্তা প্রকাশন, কলকাতা বইমেলা ২০১৮) নির্বীর্যতার জতুগৃহ ( বার্তা প্রকাশন, কলকাতা বইমেলা ২০১৯)

    অবক্ষয়

মৃত হৃদয় নিয়ে অয়সের মতো

শব্দের সিঁড়ি বেয়ে মুক্তির পথ 

ভাসিয়ে দিচ্ছে জীবন গাঙুরের ঘোলায়। 

কান্না শুধু কান্না আলোক স্রোতে 

স্পর্শের অবৈধতায় চন্দ্রগ্রহণ 

ছায়ারা বিদর হলে প্রত্যাশাহীন 

নরম মাটির ওপর, আছড়ে পড়ছে হাত। 

পরপর ঘড়ি সাজিয়ে মৃত্যুগামী

বেষ্টনীর আবদ্ধে তপ্ত শোধন কলা,

যা যাওয়ার তা পারতো ভেসে যেতে। 

নির্জীব হৃদয়ে ছাই রাঙা বায়ু

জৌলুস ছেড়ে যাওয়া বিদগ্ধ ময়ূরী 

বৈতরণীর সামনেই বসে থাকা, 

সজীবতা আর বেঁচে থাকার পার্থক্য যে অনেক

এ তুমি বোঝাবে কাকে!!

নেপথ্যচারী

পাখার তিনটে হাত, 

মানুষের দুটো

হাত দিয়ে মানুষ পাখা লাগায়।

পাখার মাথার শক্তি মানুষের দেহ 

ধরে রাখে,

হত্যা আসলে করে মাধ্যাকর্ষণ। 

অভিকর্ষজ ত্বরণ শূন্য হলে এই 

প্রকার দুঃসংবাদ আসার ছিল না..

      স্থানীয় সংবাদ 

ফেলে রেখে গেছো অকৃত্য যা, অদ্ভূত নীল 

সেসবে এখন আর কোনও দ্বিধা নেই। 

লোহার তফাতে এসে দাঁড়ায়েছে যারা..

সুদীর্ঘকাল শেষে আজও বিপ্লবী মেঘ। 

এই দেখো কালের ধ্বনি রাঙাচ্ছে শান 

ডুব দিতে এলোমেলো নৌকোর খোল 

চেতনার চামড়ায় স্থানীয় সংবাদ 

গলনের ধারা মাপে মোহের কামান। 

ঘুম ঘুম বৈভব, অস্বচ্ছ ক্লান্তির সুর

পিছুডাক আজও তবু পুরনো অভ্যেস। 

ফেলে রেখে গেছো অগ্রন্থিত অক্ষরমালা, মায়া ধূসর

কাগজের অভাবে শোকবার্তার প্রাচীরপত্রে

         পাশে

ছেলেটির মৃতদেহ রেললাইনের পাশে 

অথবা ছেলেটির মৃতদেহের পাশে রেললাইন। 

মাথা কেটে পড়ে আছে লাইনের পাঁজরে। 

গতরাতে ছেলেটি সেরে নিচ্ছিল ভয়ানক রকম হস্তমৈথুন, 

প্রেমিকা আর তার বৈধ স্বামীর উত্তাল সঙ্গম দৃশ্য দেখে.. 

চোখ ছিল কল্পনার লাল আভায়।

ছেলেটির মৃতদেহ পড়ে আছে রেললাইনের পাশে। 

এখনও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এসে পৌঁছায়নি কেউ.. 

নামান্তরের অপেক্ষায় শুয়ে আছে প্রেমিকা 

তার বৈধ স্বামীর লাশের পাশে।

——————————————————————————————————————————-

      কবি পরিচিতি -ঃ ইনাস উদ্দীন

  মুর্শিদাবাদে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, বর্তমানে কৃষ্ণনাগরিক। পড়াশোনা অর্থনীতি বিষয়ে,  পেশায় সমবায় বিভাগের  আধিকারিক — নেশায় সাহিত্য-সংস্কৃতি।  দুটি কবিতার বই আছে — ‘ইচ্ছেলেবু’ এবং ‘ড্রামওয়ালা’। এছাড়া আছে আকাশবাণী ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত চিঠিপত্রের সংকলন ‘চিঠিচাপাটি’।

১. যে কবিতা লিখতে পারিনি আজও 

এখনো তার সন্ধান চলে 

সে ভারি আশ্চর্য কথা 

সে কেন আশ্চর্য হলো —

তারও খোঁজ চলে

সে আবার আশ্চর্য আরেক

খোঁজ চলে আগের মতোই

অথচ কিছুই আর আগের মতো নেই 

শরীরে ও মনে আগাছা অনেক 

চশমার সাহায্য নিয়েও দৃষ্টির জোর আর নেই,

      সেই আগের মতন 

     ইচ্ছেও কি আছে?

তবু দেখি খোঁজ জেগে আছে

অন্ধকারে ইঁদুরের মতো 

খুদকুঁড়া খোঁজ করে চলে 

যদিও গর্তে বোঝাই 

          ধান কাটা শীষ

সে কি অভ্যেস শুধু?

খোঁজ খোঁজ খোঁজ! 

আর কোনো ইচ্ছে নেই? 

২.   

যদি সে কবিতার  সত্যি দেখা মেলে

যদি কোনো নিস্তব্ধ রাতে

হঠাৎই লিখে ফেলি

  সেই কবিতাটি

যাকে আমি খুঁজেছি এতোদিন

যার জন্য হাপিত্যেশ কাগজ কলম

কেটে গেছে দীর্ঘ সড়ক পথ

ঝমাঝম ছুটে চলা রাত 

বারান্দা-উঠোনে শান্ত সন্ধ্যাগুলি

লোকাল ট্রেনের শেষে ক্লান্ত

 সন্ধ্যাগুলি 

সে যদি সামনে আসে

চিনতে পারব তাকে?

এই তো সেই! 

যাকে আমি খুঁজেছি অনেক? 

সকাল হলে যাকে দেখে চমকে যাবে লোক

এপাড়া সে পাড়া কানাকানি হবে 

শোরগোল হবে 

রূপে যার বিধ্বংসী আলো! 

কন্ঠে যার ধ্বনিত তীক্ষ্ণ বাণ

          শাণিত সুন্দর! 

সুরলোক ঈর্ষান্বিত হবে

অসুরলোকের চোখে 

             না বোঝা বিস্ময় —

কিভাবে চিনব তাকে

এই সেই কিনা?

যে চিনিয়ে দেবে

সেকি আজও জেগে আছে 

         আমার ভিতর?

 ৩.  

যাকে আমি খুঁজে গেছি 

তাকে দেখিনি কখনো

তার অবয়ব, আকার প্রকৃতি 

কেমনটা হতে পারে —

        স্বচ্ছ কোনো ছবি আঁকা নেই

 বাইরের ক্যানভাস কিংবা

                       ভিতরের পটে।

 যতবার ভাবি,  ধারণা বদলে যায় 

       সে যেন এইরকম হতে পারে 

       কিংবা ঐরকম 

একটা মানুষকে খুঁজছি

তার সাক্ষাৎ চাইছি 

তার বন্ধুতা চাইছি

তার সঙ্গ চাইছি

চাইছি উষ্ণতার বিনিময় —

অথচ সে কেমন মানুষ

       সেটাই জানিনা 

আদৌ কি আছে সে মানুষ 

এ জগত সংসারে?

এরকম থাকবে কি কেউ

যে শুধু আমাকেই খুঁজে ফেরে?

—————————————————————————————————————————–

   কবি পরিচিতি-ঃ গণেশ কোলে

  জন্ম কালনা শহরে। থাকেন দিদিমার বাড়ি। চৌতিশা র সদস্য।

অমীমাংসিত 

প্রতিদিন জমি হারাচ্ছি একটু একটু করে

আজকাল তোমাকে ছুঁতে চেয়েও 

অওকাত বুঝে চলছি…

কয়েক যুগ মুখোমুখি থেকেও 

বোঝা গেল না সীমানা কোনটা,

কোনটাই বা মিলন ক্ষেত্র !!

নিরুপায় হয়ে যখন তোমার চোখে চেয়েছি

মন বলেছে-

‘নিঃশব্দ হও

এবং ভালোবাসো’

   ‘তোমরা যে বলো দিবস-রজনী’

ভালোবাসি ভালোবাসি 

ভালোবাসিই তো,

কেন, বিশ্বাস হয়না,

প্রমাণ চাও বুঝি ?

বলো কী প্রমাণ চাও—

হাতটা কেটে ফেলবো এখনি,

চলন্ত রেলের সামনে দাঁড়াবো,

অথবা সামনের তিনতলা বাড়িটা থেকে ঝাঁপ দেবো ?

তোমরা যে বলো–

ভালোবাসা ভালোবাসা 

‘ভালোবাসা’ আসলে একটা ক্ষতস্থানের নাম,

যতবেশি রক্তক্ষরণ হয়

তত বেশি ভালোবাসি !

   যখন আমি কোথাও নেই

মনেকরো, আজ হঠাৎ করে বললাম,

‘ভালোবাসি’

তারপর চুপ করে গেলাম 

সন্ধ্যা নামলো ঝিঁঝিঁ শব্দে,

রাত্রির নিস্তব্ধতা !

তুমি হঠাৎ করে ভয় পেলে,

চিৎকার করে বললে—

‘‘কো থা য় তুমি?’’

আমি নিরুত্তর রইলাম,

তুমি চারপাশে হাতড়াতে লাগলে

তোমার চোখে জল!

তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি

আর বলছি “ভালোবাসি তোমাকে ”

আচমকা তোমার স্বপ্ন ভেঙে গেলো,

ভয়ংকর অন্ধকার সবদিকে !

তখন আমি কোথাও নেই…

——————————————————————————————————————————-

    কবি পরিচিতি-ঃ খুকু ভূঁঞ্যা

      জন্ম: ১৯৮৪ সাল ২২শে অক্টোবর

স্থান:পিংলা থানার অন্তর্গত জলচক সংলগ্ন জঁহাট গ্ৰামে।

শিক্ষা: মাধ্যমিক।

পেশা: গৃহবধূ।

লেখালেখির শুরু: শৈশব কাল থেকে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত,২০১২ সাল থেকে।

প্রথম প্রকাশিত পত্রিকার নাম,ভারতী সাহিত্য পত্রিকা ভেমুয়া,সাগরপুর,সবং।

ক্রমে,মাটি, দৌড় ইসক্রা,প্রোরেনাটা,আয়ু,কবিমন,কবিতীর্থ চান্দ্রমাস আপনজন আরো অসংখ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮সালে।

প্রকাশিত কাব্যগ্ৰন্থ দুটি।

১:লেপের আদর খোঁজে ফুটপাত।

২:। মাটিপাঠ।

দাঁড়ের শব্দ

সন্ধ্যা রেখা ধরে উড়ে যায় পাখি,

উধাও হয়ে যাওয়া মোরাম পথ ঢালাই সৌখিন,

জমির পাশে খুন হওয়া গাছের গুঁড়ির ওপর মগ্ন পিঁপড়ের আহ্নিক,

কেসুতিফুল দেখছে গুঁড়ো গুঁড়ো মেঘ জমছে সাগরকোণে

বোরজের পাশ দিয়ে ফেরা আলের গায়ে সোহাগি ধানশিষ

চুমু দিয়ে ভালোবাসা বোঝায়

হয়তো বা মাটির আঁচলে রেখে বিশ্বাস ছুঁতে চায় লক্ষ্মীঝাঁপি

শুভ অঘ্রাণ

কে কতটা সত্যি হব চিতায়—

ভাবতে ভাবতে লেখা হবে না শেষ চিঠি

স্বপ্নেরা সাদা পোশাকে প্রার্থনায় রত,সফেদ উত্তরীয় ভ্রমে ঘাড় ঘোরালেই সংখ্যাটা বেড়ে যায়

পালক ঝরছে

কে হবে আয়ুষ্মান

পৃথিবীর শেষ ট্রেনে বসে কে লিখবে মৃত্যু বিজয় ইতিহাস–

থাক সে কথা

সাদা সংখ্যার দিকে তাকিয়ে চোখ কুয়াশা

এসো বাউল পাখি

আঙুল ছুঁয়ে থাকো,

প্রশ্বাসে বাজুক দাঁড়ের শব্দ–

      মৃত্যুমণি

কে কাকে একা করে যাব সেই ভাবনায়

বৃষ্টির মতো বাজছি রাত্রিদিন।

মাঠ থেকে ফিরে দ্যাখো,

দীপ নিভে গেছে,

বাটনা বাটার আওয়াজ নেই,

নিঃশব্দ ভাতের হাঁড়ি,

দুচোখে বিষ পিঁপড়ের সারি,

নিথর শরীরে খেলা করছে উত্তরা হাওয়া।

বলবে কি, সবজি লাগিয়েছি,তলা ফেলেছি হাঁস মুরগি কিনেছি কারজন্য?

গম শিষের মতো স্বপ্ন, সোনা ধানের মতো আনন্দ আদর

তোমার জন্য লালন করছি বুকের ফাটলে।

রূপ খাইয়ের তলা শুকোচ্ছে,

চলো ক সেউনি জল দিয়ে আসি।

বাড়িয়ে দেব স্তব্ধতা

আরো শক্ত করব চোয়াল, মুঠো, চোখের পাতা,

এমন সময়,যদি জ্ঞান হারাতে!

পারো ভালোবেসে পাগল হতে?

দাঁড়াতে দেখিনি,

ব্যস্ততা শ্রমের ভিড়ে যন্ত্রমানব ঘুরে ফেরে।

পারো কি বাউল হতে?

উদাসী কবি?

খাট চাই না, পালঙ্ক চাই না

চাই না শ্বেত পাথরের ঘর।

চালা ফুটো করে বৃষ্টি দেখে কেটে যাক ইহকাল পরকাল

শুধু একমুঠো কবিতা দিও চিতার পাশে–

    ছায়া ঢিবি

ইদানীং একটা ভয় ছায়ার মতো তাড়া করছে,

চেনা রাস্তা খিস্তিগাড়ি কিংবা শুঁড়িখানার আকাট মাতাল।

চৌরাস্তা পেরোতে গেলেই একটা ভারী লরি পিষে ফেলতে চায়।

অথচ এতো মৃত্যুভয় ছিল না

চোখ খুলছি না শকুনের ভয়ে,বুঝি খুবলে নেবে শ্বাস

সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি।

ভেসে উঠছে দিল্লির দশতলা থেকে লাফিয়ে পড়া রামমামার মুখ,

ক্ষতর দুর্গন্ধ হাওয়ায়,

কাল পেঁচা ডাকছে উঠোন গাছে।

গা ছমছম ভয়,

উঠোন থেকে পুকুর ঘাট হি হি কাঁপুনি

কেউ আছো? একটা মোমবাতি জ্বালো

আলো দাও,জোনাক ওড়াও

ভেঙে দাও ছায়া ঢিবি

আলোর পদশব্দ বাজুক অন্তর বীণায়–

——————————————————————————————————————————-

 কবি -ঃ  সমরভূষণ দে

———————————————————————-  

কবি পরিচিতি-ঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১২ মে ১৯৭২ (সরকারী খাতায় ২ জুন ১৯৭২) ।পেশায় অধ্যাপনা ।রবিশস্য (৭খন্ড),হুগলি জেলার নৌ শিল্প,মোহিতলাল অন্বেষা,ঈশ্বর গুপ্ত জীবন ও সাহিত্য,শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত কথা,হুগলি জেলা ও রবীন্দ্রনাথ,হিরণ্ময় স্মৃতিতে স্যার আশুতোষ সহ ২৫ টি প্রবন্ধ গ্রন্থ ।কাব্য গ্রন্থ-রুগ্ন যুবকের জার্নাল ।দেশ বিদেশের শতাধীক জার্নালে লিখেছেন ।পেশায় অধ্যাপনা ।

  আমার নদীকথাঃ। ৩

যন্ত্রের চামড়া থেকে সুর ওঠে ,ভেসে যায় হৃদয় জলপথ

সেই সুরে বেজে ওঠে আমাদেরই যন্ত্রনা দগ্ধ মনের পর্বত |

পর্বত চূড়ায় বসে ব্যথার আলোয় ভাসে সুর দগ্ধ চূড়া

যন্ত্রের সুরের ভেতর ব্যথা হয়ে খেলা করে হৃদয় শিশুরা |

ধ্বনির খোলস ছাড়ে ব্যথার নিবিড় কথা এক থেকে দুই 

যন্ত্র নিবিড় বাজে ,ব্যথা হয়ে .,এ সবই জানতিস তুই |

যে সুর বাজাত যন্ত্রনার ভেতর থেকে শূন্য চরাচর

এখন থেমেছে সুর,হাহুতাস করে চলে একাকী চালাঘর |

শিল্পীর  আঙুল  থেমে গেছে, ধূলো এসে বসেছে সাক্ষী রেখে

ধূলোর ভেতরে পথ চলি,নির্জন আলপনা আঁকি থেকে থেকে

   জলকথা

জল থৈথৈ জলের অথৈ

জলের ভেতর দাঁড়িয়ে তারা

জল থেকে ওই হাতছানি দেয়

নদীর জলে মিশলো যারা |

নদীর জলে জল হয়েছে

একমুঠো ছাই হৃদয়গামী

জল ডেকেছে আমায় যেতে

জলের কাছে দাঁড়িয়ে আমি |

যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি

নদীর ওদিক অন্ধকারে

একলা আমি আমার কাছে

জল ডেকেছে বারে বারে |

হৃদয় গভীর মাটির ভেতর

শীতল শীতল জলের ছোঁয়া

নদীর বুকের মাটির কাছে

তোমার জন্যে হারিয়ে যাওয়া |

হারিয়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া

নাভীকুন্ড একমুঠো ছাই

বিকেল বিকেল রোদ পড়েছে

নিজের কাছেই নিজে দাঁড়াই |

নিজের কাছে নিজের যাওয়া

ডাকছে যারা অতীতগামী

অপেক্ষাতে নদীর কাছে

জলের ডাকে দাঁড়াই আমি |

মেঘমল্লার

এই ঘরেতে মেঘ করেনি আজও

তোর ঘরে রোজ মিয়া মল্লার সাজে

এই ঘরে রোজ দহন দহন খেলি

তোর ঘরে রোজ মেঘের সেতার বাজে |

এই ঘরে রোজ ব্যথা গুচ্ছ ঘাস

তোর ঘরেতে খাঁচার সুখ পাখি

ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরএই ঘরে বারোমাস

নরম সূর্য তোর ঘরে মাখামাখি |

এই ঘরে আসে কালরাত্রির চাঁদ

তোর ঘরে আছে পূর্ণশস্য মাঠ

এই ঘরে ব্যাধ প্রতিদিন পাতে ফাঁদ

তোর ঘরে আলো ভাসাচ্ছে ইটকাঠ |

এই ঘর আছে থমকে একটি যুগ

ওই তোর ঘরে নদীর সেতুর ছায়া

এই ঘরে তবু তোকে ছুঁয়ে আছে বুক

ওই তোকে ঘিরে নেই নির্জন মায়া |

আমার জানালা তোকে ঘিরে আছে থাক

এখনো বইছি সেই সেই একখাতে

তোর ব্যাধ বাণে  ফিরে ফিরে ব্যথা পাক

তবুও আগুন জমেছেই এই হাতে |

পোড়া ঘর বেয়ে সূর্য লুপ্তপ্রায়

পোড়া ঘর বেয়ে স্তব্ধ বসুন্ধরা

পোড়া ঘর বেয়ে দুঃখরা আছড়ায়

পোড়া ঘরে বসে রবি ঠাকুরকে পড়া |

এই ঘরে ভাসে বেহুলার মান্দাস

লখিন্দরের নিথর দেহের ছায়া

দরবারী রাগে গাইছে তুলসীদাস

গ্রীষ্ম পুকুর নেশা নেশা রোদ মায়া |

——————————————————————————————————————————-

    কবি পরিচিতি-ঃ  নবনীতা দত্ত

         পিতা রথীন্দ্রনাথ দত্ত, মা রেখা দেবী। নিবাস মুর্শিদাবাদ জেলার দক্ষিণখণ্ড গ্রামে। স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। লেখা লেখির শুরু অনেক কাল আগে থেকে বলা যায় স্কুল বেলা থেকে… বিশেষ পুরস্কার হিসাবে “কবিতায়ন” পত্রিকা থেকে “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি সম্মান 2016” এছাড়াও আরো কিছু সম্মান প্রাপ্ত হয়েছে..

                           

  পলাতকা ছায়া ফেলে

  নিরন্তর স্থায়িত নয় কাঙ্খিত

ক্রমান্বয়ে চলে নীরব আসা যাওয়া, 

পথ ভোলা পথিকের মতো

যেনো বিচলিত ধুলো বালি হওয়া।

আমি আসবো, ঠিক আসবো

ফিরেও যাবো যদি আসি

পলাতকা ছায়া ফেলে রেখে

ছড়িয়ে দেবো নির্ভেজাল খুশি। 

দশ দিক ঢাকা থাক 

অকথিত যাওয়া আসার অঙ্গীকারে

ভালো থেকো মনে রেখো

দশমিতে প্রদীপ জ্বালিয়ো অন্ধকারে।

        

 কবিতা

কবিতার প্রবল স্রোতে

ভেঙেছে কাব্য নদীর ঘাট, 

অতন্দ্র প্রহরী হয়ে

অগোছালো কবির রাজ্যপাল। 

খাম খেয়ালীর খেয়াল ভেলায় চড়ে, 

কবির ভ্রমণ কবিতা জগত জুড়ে। 

মাঝ দরিয়ায় নোঙর বাধা হবে

মানব শরীর মিশবে কবিতার শরীরে। 

সৃষ্টির সুখ সে তো অমৃতের সমান

কবির জঠরে কাঁদে কবিতার প্রাণ।

——————————————————————————————————————————-

   কবি পরিচিতি-ঃ  জয়দেব মাইতি 

 জন্ম ১৯৭৬ এর ১৪ আগষ্ট। কলাগেছিয়া খেজুরী পূর্ব মেদিনীপুর। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি। যন্থস্থ একটি। সম্পাদিত বই তিনটি।সম্পাদিত ‘ কবি লেখক আত্মকথন’ ‘২য় খন্ড ও যন্ত্রস্থ।সম্পাদিত পত্রিকা যদি জানতে (১১ বছর)’। 

প্রেম- কবিতা। 

ভালোবাসা – বাগান করা,ক্যুইজ আর নতুন মানুষের সঙ্গ লাভ।

অভিমান – চাটুকারিতা দেখে ফেলা। 

মনের কথা – বিশ্বাসে এখনও বাঁচি।

 সম্পর্ক 

সেই যে বলে গেলে, ভুলে যেও-

তারপর চলমান শরীর বেয়ে, কত নদীর 

আত্মীয় হলাম একযুগে।

দেখা- শোনা -বলার নামতা  আর আগের মতো আসে না 

তবুও  ‘ভুলে যেও’ কে ভুলে  যেতে, এখনও আমার অসুখ করে

   টান 

আর কেন অভিমান? 

নিহত ঢেউগুলো আবারও জেগে ওঠে আমার বুকে।

বেদনাহত আমি, নিজেকে খুঁজি উদ্দামতার শব্দে –

লাটাই হাতে খেলাতে চাই – আকাশের সহচর। 

ঘুড়িটা বুকে নিয়ে স্বঘোষনা করি,

ভালোবাসা যতই মিহি হোক – ছিঁড়ে ফেলা এত সহজ নয়।

———————————————————————-

কবি পরিচিতি-ঃ দেবানন্দ বিশ্বাস

 

জন্ম: ৩রা জানুয়ারী, ১৯৬৯ হুগলী জেলার কালিয়াগড় গ্রামে। বর্তমান বাসস্থান : বলাগড়

শিক্ষা : বাংলা স্নাতক , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

পেশা : কলকাতা পুলিশ

লেখা শুরু :১৯৮৬তে

প্রসাদ, কাগজের নৌকা, স্বপ্ন, কলেজ স্ট্রিট, অন্যদিন, নৌকা,  উৎসব, তথ্যকেন্দ্র  সহ অসংখ্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশ। সম্পাদিত পত্রিকা- শ্রুতি ।

গ্রন্থ : বলাগড়ের ইতিহাস , ছড়াছড়ির দেশ।

পুরস্কার: সোমরা প্রবাহ সংস্কৃতি সংস্থার 2018-19 কবিসম্মান লাভ। 

কবিতা ১

তাদের জন্য

আমার মন চলেছে চাঁদের আগে

চাঁদ কেটে তরমুজের ফালি করে দেব বলেছি

যাদের থালায় রুটি নেই 

মূলত তাদের জন্য

একটা মেঘ নিয়েছি মুঠোয়

চৈত্র বৈশাখের জন্য জমা করেছি

যাতে সিক্ত হয় প্রেমিকার মন

  

একটা বিদ্যুৎ রেখেছি পাঁজরে

যাতে জগদ্ধাত্রী পূজায় আলোকসজ্জা হয়।

কবিতা ২

ছাই

আমি আকাশ হতে পারিনি

সে তো লক্ষ কোটি যোজনের গল্প

আমি চাঁদ হতেও পারিনি

চন্দ্রবিন্দুতেই আবর্তন করি

আমি হতে চেয়েছিলাম তারা

সেই দিনেতেই কুকুরগুলো

মাতিয়েছিল পাড়া

আমি ভেবেছিলাম হব নদী

শ্মশান ঘাটে পুড়ে পুড়ে 

খাঁটি হই যদি

আমি হতে চেয়েছিলাম ফুল

ছোট্ট বালক বলেছিল

আমি পরবো কানে দুল

আমি ভেবেছিলাম হব পাখি

বিশ্বলোকের ভাইয়ের হাতে

পরাব রঙিন রাখি

আমি শীত সকালে সূর্যটাকে বলেছিলাম ভাই

এক পলকের দহন তাপে 

হয়েছিলাম ছাই ।

কবিতা ৩ 

স্বাদ

তটিনী আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই

মিলিয়ে যায় ছায়ার মত আমার শরীরে

আমি জীবন নদীর তীরে বসে

অমৃতধারায় সুর দিই

তটিনী আমার সুরে গেয়ে ওঠে খেয়াল

আমার কোষে কোষে নটরাজ হয়,বীজ বোনে

গর্ভিনী হরিণীর মত নত মুখে

আমার সম্মুখে আসে

শরীরে শিশির জমে

আমি গর্ভিনীর মুখে চুম্বন আঁকতেই 

ছায়া হয়ে লতিয়ে যাই ওর শরীরে

তটিনী মৃদু হেসে বলে, বুঝে নাও জন্মকথা আর আমার বিচিত্র রূপ,রস,গন্ধের স্বাদ।

—————————————————————————————

 কবি পরিচিতি-ঃ  

সুভাষ চন্দ্র মিত্র  

বিজয় কৃষ্ণ কলোনি,

শ্রীপুর বাজার, বলাগড়, হুগলী. অবসর প্রাপ্ত 

প্রাথমিক শিক্ষক. বর্তমানে অঙ্কন শিক্ষক. প্রথম 

প্রকাশিত — জাপানি হাইকু ছন্দের কবিতা গ্রন্থ 

“তেমন কিছু নয় তবু”. 

জাপানি ‘তানকা’ ছন্দের কবিতা :

1.    টুকরোগুলো 

           ছেঁড়া চাঁদটা 

            জুড়ে যায় যেদিন, 

                সেদিন কেন 

           যায় না জুড়ে — মন 

           ভাঙা টুকরোগুলো !

2.    বেয়াকুফ 

              তোমার চুপ 

          মন -মলাট খুলে 

             পড়তে বসে, 

          রহস্যের জলে 

          হয়েছি বেকুফ. 

3.    সব ঠিক 

             ঘরে অনেক 

         টিকটিকি, সত্যি 

             বা মিথ্যে যা 

         বলব, টিকটিক 

         সায়’দে ঠিক — ঠিক. 

4.  প্রেম গাছ 

            প্রেম একটি 

         বিশাল মহীরুহ, 

            শাখা -প্রশাখা 

         ছড়িয়ে আছে তার 

          চতুর্দিক জুড়ে. 

5.  প্রবন্ধ পড়ব 

            আঁধার ঘন 

        রাতের প্রবন্ধ 

            পড়ব বলে, 

         অমাবস্যা রাতে 

         জোনাকি -মোম জ্বলি. 

—————————————————————————————

 কবি পরিচিতি-ঃ  দেবাশিস মিশ্র।

জন্মতারিখ-৬ই অক্টোবর, ১৯৬৬।

ঠিকানা-‘দ্বারাবতী’, পশ্চিম কুমারপুর, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর, পিন-৭২১৪০১, ভারত।

শিক্ষাগত যোগ্যতা- ইংরেজী সাহিত্যে এম. এ.।

পেশা- শিক্ষকতা।

প্রত্যয়

পথের খোঁজে বেপথু মন হতাশ কেন নিরন্তর?

হলুদ পাতা ছড়ায় দেখে ভাবছ- রাহা মিলবে কই?

দিকচিহ্ন সুলুক দেবে, ঘরের মাঝে যেমন ঘর;

তাগিদ যদি তোমার থাকে, হদিশ পাবে অবশ্যই।

পথের সীমা দিগন্তরে, আবছা আলো চুপকথায়,

শেষ ঠিকানা অনেক দূরে, সেই ছবিটা বিবর্ণই।

গল্প জমে, গল্প কমে প্রতিদিনের রূপকথায়;

আধার যদি তোমার থাকে, যুক্ত হবে অবশ্যই।

পথের দাবী যেমন আসে, তেমনতরো চালচলন,

শৈত্যভূমে ঝিমিয়ে সব, স্বার্থ মেপে চলনসই।

বুকের মাঝে সঞ্চিত যা, তাতেই হবে আন্দোলন;

বারুদ যদি তোমার থাকে, আগুন পাবে অবশ্যই।

বন্ধু, এসো, অচলগড়ে ‘চরৈবেতি’ মন্ত্র হই,

বর্জ্য যা, তা দাহন করি, সমীধ পাবো অবশ্যই

 রাস্তা

একটি পথে সব রাস্তা মেশে,

তাইতো বড় সহজ গতিবিধি।

রাত নেমেছে নিখাদ ভালোবেসে;

হদিশ পাবে, জ্বালিয়ে রেখো হৃদি।

রজঃস্বলা রাত্রি শুধু জানে

মানুষ একা রাস্তা খোঁজে নাকো।

রাস্তা খোঁজে মানুষ সবখানে,

নদী পেরোয় যারা বানায় সাঁকো।

সাঁকোর পারে দিকশূন্যপুরে

মানুষ আর রাস্তা একাকার,

প্রার্থনাতে মেশানো সব সুরে

অমানুষতা নিয়ত ছারখার।

রাস্তা জানে দিতে এবং নিতে,

রাস্তা গড়ো জীবন নগরীতে।

 ফসিল

মানুষগুলো নরম বড় আজ,

মিছিলজুড়ে ছড়িয়ে আছে তাজা।

লাশগণনা মহৎ কারুকাজ,

কালবেলাতে শ্মশান জাগে রাজা।

রাত যদিও নামলো কাছেপিঠে,

বিচারসভা লক্ষ্য করে নি তো।

ঘনায় ছায়া পাথরে আর ইঁটে,

রাতকানারা মৃত্যুভয়ে ভীত।

তত্ত্বকথা আফিমে মশগুল,

তরজাগুলো লোকদেখানো, জোলো;

ভুললো মালী কোথায় ফোটে ফুল,

প্রশ্ন শুধু, রাত কতটা হলো?

কোথায় আলো, কোথায় আছে বাঁচা-

শেকল ভেঙে জানে তা ঘরপোড়া।

উলঙ্গ যে রাংতা-ওঠা খাঁচা,

প্রাণ পেয়েছে কাঠখোদানো ঘোড়া।

জীবন পেলে ঘরের মাঝে ঘর

ফিরতে হবে বিপন্ন সম্বিতে;

আগুন যদি লাগে পরস্পর,

জেহাদ হবে আঁধার নগরীতে।

প্রলয় হলে ভাগাভাগির খেল

সাঙ্গ হবে, কাল শোনাবে সাজা।

দিগন্ত যে আশাতে উদ্বেল,

গল্পশেষে ফসিল হবে রাজা।

——————————————————————————————————————————-

    কবি -ঃ মানিক দেবনাথ 

     

দেহ ৩০

হটাৎ করে মন টানলো রাস্তা,

বিষাক্ত আঙ্গুলে

মানব নির্যাতন.

ধস্তাধস্তির পর

বেশ কয়েকটা আচর বিবেকে,

ফুটপাত ঘিরে আরো কিছু দর্ষক

থাকলেও সিধ কাটার উপায় নেই.

নবান্নের জল কাটতেই

মুখ লুকালো প্রতিবেশী,

অথচ আধার নামেনি সিঁদুরে।

                        

প্রেমের কবিতা

আমি হইনি তোর গর্ভে

তুই আমার কাছে নতুন

আঙুলের মতো সহজ। 

আমি সিদ্ধান্তে অটল

শিশির পরলে

ভোর বেলা ঘুমতে যাই। 

আমি বিবেকের মতো স্থির

পাঁচ কান হইনা সোহাগে

আড়াল  থেকে বাহন হই। 

কান ঘেঁষানো চুল হয়ে

চোখের পলকে হেসে ফেলি। 

তবুও পৃথিবী হয়ে পাশ ফিরলে

ডাক পিওনের মত ঠিকানা খুঁজি

প্রথম দেখা 

সেবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম 

ঝিরিঝিরি গাছের নীচে 

লক্ষাধিক প্রাণ।

কোথাও আবার রোদের গন্ধে 

আবির মিশছে।

আমিও ছিলাম সেখানে 

আর ছিলে  তুমি।

লাল পার শাড়িতে

বৃষ্টির মতো, নরম লাগছিল তোমায়।

মুখে রঙবে রঙের  আবির।

তুমি বোধহয় জানতে না

সেদিন প্রেম এসেছিল দেহে।

পাছে তোমার স্বামী না টের পায়।

দূর থেকে আবির ছুঁয়েছিলাম মনে।

ভীড়ের বুকে লুকিয়েছিলাম ভালোবাসা।।

                               

অনলাইন চৌতিশা সাহিত্য পত্রিকার প্রথম পাক্ষিক

কবি পরিচিতি

 চিরপ্রশান্ত বাগচী

জন্ম : ৩ জানুয়ারি ১৯৫৯ । বীরভূম । বর্তমানে অবস্থান : হুগলি জেলায় ।

শিক্ষা : বাংলায় স্নাতকোত্তর ও শিক্ষক -শিক্ষণ প্রশিক্ষণ যথাক্রমে বর্ধমান ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ।

পেশা : ১৯৮৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত হুগলি জেলার সুপ্রাচীন ও নামী একটি উ মা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ।

এখন অবসৃত ।

লেখালিখি : দেশ এবিপি কৃত্তিবাস প্রসাদ চালচিত্র সাগ্নিক ট্রাপিজ আর্ষ স্রোত শ্রুতি কাগজের নৌকা প্রভৃতি পত্রিকা ।

কাব্যগ্রন্থ : তিনটি : ১। নীরা, শুধু সুনীলের নয় । ২। ভাষা, অন্তঃস্থিত আগুন । ৩ । পোশাক আশাক বিষয়ে দুয়েকটি বেআব্রু কথা ।। গল্প বা প্রবন্ধ চর্চাও চলে পাশাপাশি । অপ্রকাশিত কবিতার পান্ডুলিপি খান দশেক বাক্সবন্দী ।

সম্মান : বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাগজের নৌকা ও পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেশকাল পত্রিকা

উদ্ভিদের আত্মকথা

পাখির ঠোঁট থেকে যেভাবে কোনও ফুলফসলের বীজ ছড়িয়ে পড়ে অথবা উড়ে উড়ে দূরে কোথাও …ঠিক তেমনি করেই এই আমি ; সেইভাবেই জন্মেছি । — যেখানে মাটি থাকলেও সরস ছিলো না । মানুষ থাকলেও তাদের ভিতরে অনেকেই দ্বিপদ ছিলো না ; আর ছিলো খাদ্য বাসস্থান ও বংশবিস্তারের পরমার্থ । এভাবেই বিভিন্ন স্তরে আমার সত্তার সঙ্গে মিশে যায় মুখকোশ ও মুখের রূপবৈচিত্র্য , আলোছায়া -সংলাপ , বিষ ও মধুর আশ্চর্য সংমিশ্রণ । তবুও তারই ভিতর আমি সেই পাথরে ফোটা ফুলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি গভীরতর । তাই আজ হাত বাড়িয়ে দেওয়া সমস্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে জরিপ করতেই থাকি , তার হৃদয় ও মস্তিষ্ক , ভাষা ও তার ত্রিবিধ গুণ । আর ? নির্মোক ; সভ্যতার । 

——————————————————————-

যারা পথ হাঁটিতেছে পৃথিবীর পথে

সেদিন যারা পৃথিবীর পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো তাদের নিরাপদ আশ্রয় অভিমুখে

কয়েকটি শিশুও ছিলো সেই পথে ।

মাটির নিবিড় আকর্ষণে ওইটুকু পায়ে কতোটা জোর থাকতে পারে ?

সময় বুঝিয়ে দিয়েছে হাড়ে হাড়ে ; তোমাকে হাঁটতেই হবে, হাঁটো

যতক্ষণ না ভিতরের আলো তোমাকে আগুনের সংকেত দেয়

হাঁটতেই থাকো আর ধরিত্রীর ধুলো মেখে নাও সর্বাঙ্গে

এখানেই তোমাদের প্রকৃত পাঠশালা

যদি লক্ষ্যে পৌঁছে যাও , হে শিশু, হে আমাদের সন্ততিসন্তান —

আমি তোমাদের পা দুটো ছুঁয়ে ভিতরে প্রবেশ করে একটা নতুন বই পড়বো , পড়তেই থাকবো , নিঃশব্দে ।

—————————————————

ছায়াশরীর

কল্পনা ; সে এমন অলৌকিক নির্মাণ যে, বিজ্ঞানের মতো আগুন আর আলোর জন্ম দিতে পারে । অনুরূপ সংঘটিত ভাব ও রসের নেপথ্যে সে ছায়ার মতো ঘিরে থাকে সতত । এ যেন শূককীট থেকে প্রজাপতির নিষ্ক্রমণ । এই যে ভণিতা বস্তুত, এ কোনও সন্দর্ভের প্রাক্ কথন নয় । এ আসলে সেই বৃত্তান্ত, যেখানে ফুটে আছে অপার্থিব এক ব্রহ্মকমল ; যার দল , ঘ্রাণ আর নান্দনিকতা কদাচ প্রকাশ্য নয় ; অথচ এমনই তার সম্মোহন ; পুরুষ প্রতি মুহূর্তেই তার জন্য রচনা করে সেই ছায়ালোক । যার কোনও ক্ষুৎপিপাসা নেই । শুধুই উড়ে উড়ে মিলিয়ে যাওয়া আকাশের ভিতরে আর এক আকাশে ; গভীরতর ।

——————————————————————

কবি পরিচিতি: 

শঙ্খশুভ্র পাত্র

জন্ম: ১৮.১০.১৯৬৩, পূর্ব মেদিনীপুরের মহানগর গ্রামে,মাতুলালয়ে ৷পিতা- শ্রীমন্ত পাত্র, মাতা— রানু পাত্র ৷ ছাত্রাবস্থা থেকেই লেখালেখির শুরু ৷ছোটদের প্রিয় পত্রিকা যেমন শুকতারা, সন্দেশ, শিশুমেলা,সুসাথী, নয়ন, আলোর ফুলকি,দুষ্টু, টাপুরটুপুর,চিরসবুজলেখা, এবং প্রথম সারির সাহিত্য পত্রিকা — দেশ, সানন্দা, আনন্দবাজার পত্রিকা,নন্দন, শিলাদিত্য, যুগশঙ্খ, আপনজন, প্রসাদ, তথ্যকেন্দ্র, শব্দপথ,কবিসম্মেলন,কৃত্তিবাসসহ বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয় ৷প্রকাশিত কবিতার বই : সাদা পাতার শোলোক (পত্রলেখা)২০০৫, নিজের ফুলের নামে ( আলো, পূর্ব মেদিনীপুর )২০১২, আত্মার সাক্ষাৎকার (সিগনেট প্রেস / আনন্দ পাবলিশার্স )২০১৭, দেখা হবে, দেখা হলে ( বোধিসত্ত্ব /বাতায়ন )২০১৮

শ্রী

অশেষ ফাল্গুনে তুমি মেঘে-মেঘে প্রতিদিন দোল…

অব্যক্ত আকাশ ঘিরে — সুরে-সুরে চতুর্দশপদী

অবন্ধুর পথে, বন্ধু — হাতে-হাত, অবাধ হিন্দোল

রাতের গহনে, গ্রহ — ঘূর্ণমান, কাল নিরবধি…

সম্পর্ক টেকে না, শুধু ঠেকে শেখা, ছন্নমতি কুহু

না- মেলালে এ-জীবন— তন্ত্রমন্ত্র, বৃথা হাঁকডাক

লালনদুহিতা— ওই অস্তসূর্যে—একবার… উঁহু…

দ্বিতীয়বারের জন্য উড়ে গেল প্রেতসিদ্ধ-কাক…

বাকরুদ্ধ-শুদ্ধাচার, সামান্য পাথর—চকমকি

আগুনের ব্যবহার— স্বপ্নপ্রভ অতীতের রং

ছন্দের বন্ধনে, ওই আরক্ত-আবেগে, তুমি, সখী

ফাগুনের ফুটে ওঠা শিমুল-পলাশে, দ্যাখো শ্রম ৷

ঋতুযান, মিথ্যে নয়— মেঘে-মেঘে প্রতিদিনই দোল

কেবল দেখার গুণে : শ্রী, যে-গান রাতের, হিন্দোল…

তথাপি তামাশা

তথাপি তামাশা, এই একুশের দিনে ? ভাষাহারা

একটি সকাল যেন কানের পাশাতে ডগমগ !

মৃদু হেসে ভোলাতে চেয়েছি আর অবিমৃশ্য তারা

আমার মাথার ‘পরে রেখে গেল সুবিশাল খগ ৷

পলাশে মেলাতে পারি আত্মদাহ — যত বনিবনা…

এতটা মধুর নয় কেকা জেনে, তুমি সেই ‘উঁহু’

সন্দিহানে নিমজ্জিত, ঘরবন্দি, নিঝুম সান্ত্বনা

হৃদয় খোঁজার ছলে কতবার ডেকে যায় ‘কুহু ৷

মুহুর্মুহু ধ্বনি — ওই প্রতিধ্বনি, অফুরন্ত ঋণে

অন্ত্যমিলে লীন হল কোনও এক নতুন লেখায়…

মায়ের ভাষাটি প্রিয়, পাশাটি উজ্জ্বল দিনে-দিনে

এই মতো শান্ত হও, সন্তরণ — কে কাকে শেখায় !

তথাপি তামাশা,ওই ছদ্মবেশ, দূর-চতুরালি —

অক্রূরসাধনে ব্যস্ত ৷ ভাষা, সে যে সুর, বনমালী ৷

মুকুর

এই তো মুকুর, ছায়া, পুকুরের জলে

অবিকল্প শীতলতা — লতাজন্ম ঢের ৷

এখানেও গাছে-গাছে পক্ষীকূল, রাতে

মাছের রুপোলি আঁশে — শতসূর্য জ্বলে ৷

সে-এক দেখার মতো— জগৎব্যাপার…

খ্যাপা চোখে ধরা পড়ে ৷ প্রবেশের দ্বার

সর্বক্ষণ খোলা, গর্ব : সরল বোধের

ওখানে জীবন যেন হাত বেঁধে হাতে

কবিতার জলছবি— রং-তুলি, ঢেউ…

বাউলের একতারা, আদিগন্ত মাঠ

শস্যকণা-কল্পনায় মজে আছে কেউ

ঘাটের রানায় জমে শ্যাওলার পাঠ ৷

পুকুরের জল, ওই তরঙ্গিত শোভা

মুকুর দেখছে খুকু : কবিতা অবাক

——————————————————————–

কবি পরিচিতি

 মনোতোষ আচার্য

পরিচিতিঃ জন্ম ১০ মে, ১৯৭৬ পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার এগরা মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রামে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা- শিক্ষকতা। প্রথম কবিতার বই ‘হিমকন্যা ও শরীর শিকারি (২০০৪)। উল্লেখযোগ্য কবিতার বই ‘বাউণ্ডুলের আত্মরতি’, ‘জোনাকিগ্রাম’, ‘একতারার পাঠশালা’, ‘গোধূলি প্রাচীন আলো’। সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘প্রদীপ্ত চন্দ্রবিন্দু’।

ভূমিস্পর্শমুদ্রা

এক.

মনে করো খেয়ালি নূপুর বেজেছিল আর্দ্র বাতাসে

আলো ডোবা পরকীয়া মাস লুকোচুরি তোমার উঠোনে

মনে করো স্কুল ফেরা হাঁটা পায়ে পায়ে আদর জড়ানো

বিকেলের চায়ের দোকান, মোড়ের মাথার মিষ্টিঘর

ভাটিয়ালি সুরের জাদুতে জেগে আছে সুবিশাল চর

আঙুলে আঙুলে ছায়া ঋণ অন্তহীন সম্বিৎ সাগর

পরজন্মে ফুটে উঠি মৃত্যুজয়ী বাগানের ফুলে

বৃষ্টি উৎসব যেন মঙ্গলসূত্রে আঁকা স্মৃতি

কাটতে চায় না আজো ঘোর…এ জীবন মায়াবী বিস্ময়।

দুই.

স্বপ্নস্বরূপিনী দেশ বুনে দিচ্ছে শিরায় শিরায় লাস্য অভিসার

মুক্তক ছন্দের মতো তটিনী প্রবাহ আর ধুলোট মানুষ

অলৌকিক জাদুকাঠি ইচ্ছে পূরণের স্বপ্নে ভাষণ বিলাস

পুরোনো গানের সুরে আলপথ, ভাঙামঠ কিছু চেনা যায়

প্রবচনে সুরক্ষিত স্তবগান, পুষ্পবৃষ্টি, চারিত্রিক লিপি

রৌদ্ররসে কীর্তি গাথা দগ্ধ দিন, পরিযায়ী রাতের জঠর

দৃশ্য থেকে দৃশ্যপট জন্ম পরম্পরা মাগধী অপভ্রংশে তোমার লিখন।

বিকেলের রামধনু সাঁঝের জোনাকি… প্রজ্ঞা ও নীরবতা মানসিক স্থিতি

বিরোধী ঝাণ্ডায় ওড়া বুভুক্ষু পাঁচালি

এসো তবে মায়ামৃগ আলোক ইশারা খুঁজে মরি!

তিন.

রঙিন স্কার্ট পরা পাখিদের মহলায়

তুমি কি গাইবে না আধটা গান

একটু দম নাও

গলাটা সারিয়ে মিটিয়ে নাও না মান-অভিমান।

মাটি ও ভিজবে ক’ফোঁটা বৃষ্টিতে

আহা কী জমকালো সাজ-পোশাক

মুখোশে মুখ খুঁজি আমিও বুদ্ধু

তালিতে ভেসে যাই, গালিতে চুপ

অয়দিপাউসের দাও না ক্যাচটা

নান্দী জমে ক্ষীর, তোড়ি ও তানপুরা

নূপুরে বেজে ওঠে অধিকারী…

চার

ভাঙা প্রতিশ্রুতি ও কানা অবজ্ঞার হাওয়ায়

ভেসে চলা ছেঁড়া ঠোঙাটির মতো জীবন যাপন

চোখের আড়ালে থাকে ঢঙ্… সুখ স্বপ্নে চোখ বুজে

নতুন ভাস্কর্য খুঁজে দেবী প্রতিমায়

আগুনপাখির গল্প আর তোলপাড় করে আনি সারাটা পৃথিবী।

শীতার্ত সরীসৃপ হাই তোলে শিকড় বাকড়ে, স্পর্শ করি প্রাগার্য নির্মাণ

আত্মখনন শেষে চেয়ে দেখি রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে

আদিভূতার থানে মানতের ঘোড়াগুলি।

পাঁচ.

রোজকার হুটোপাটি অক্ষর দলন শেষে আত্মচরিতে আঁকি নীল অভিমান

মৃত্যুর মিছিলে ভাসে নিরুদ্দেশ পথ তবুও বাতাসে ভাসে শান্তির ব্রতকথা

স্নান-স্নিগ্ধ সন্ন্যাসিনী প্রসারিত দৃষ্টি দিয়ে শোনাতেন অনন্তের গান

কর্মযোগ পাঠ সেরে নিষিদ্ধ আলোর ইশারায় খুলে যায় মহানন্দা স্রোত…

হৃদয়ের ঝোরা বেয়ে নেমে আসা ঘূর্ণির উচ্ছ্বাস দেখি প্রায়ান্ধকারে

কথাটুকু উবে যায়, রয়ে যায় অনিবার্য সম্পর্কের ছাঁচ

বিফল আত্মার ধ্বনি মিশে যায় কান্নার শরীরে…

——————————————————————–

কবি পরিচিতি–

ঝিলম ত্রিবেদী

জন্ম ১৯৮৪ সালের পৌষমাসে। “দর্শন” নিয়ে পড়াশোনা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখায় প্রবেশ বেশ পরে, ২৭/২৮ বছর বয়সে।

অনুভূতির গভীরে তাঁর লেখার শিকড়। তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণ আমাদের সকলকে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। বিষয় বৈচিত্রে, ভাষার প্রয়োগে, শব্দের ব্যবহারে ঋদ্ধ তাঁর লেখা পাঠ করা, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর লেখনী একাধারে যেমন চাবুকের মত উদ্ধত, তেমনই আবার ভালোবাসার মত কোমল। কবিতার পাশাপাশি চলছে গদ্য ও নাটক লেখা-ও।

২০১৫ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা”-র প্রকাশ। ২০২০-র বইমেলায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “বৃষ্টি পড়া বাড়ি” প্রকাশিত হয়, প্রতিভাস প্রকাশনা থেকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন। “দেশ” অনলাইন পত্রিকায় “নির্বাচিত কবি”-র সম্মান প্রাপ্তি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে, আমন্ত্রিত কবি হিসেবে, ৪র্থ বাংলা কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণ।

লিখতেই হয় তাঁকে ঈশ্বরের অদৃশ্য নির্দেশের মত।

লিখে যাবেন, যতদিন তিনি লিখতে বলবেন।

একলেয়ার্স

তাদের সদ্য কেনা বিকেলের একতলায়

মা ঘুমচ্ছিলেন

বুকের উপর চৈতন্য

সে পাশের ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল

শুনল

ডাক

সে ডাকল তার নাম ধরে-

ছাদে উঠে গেল নূপুরেরা

ছাদ…..

সেই দূর দারোয়ান কাকার ভজন

একফালি লোডশেডিং

ছায়া ঘিরে আসা শরীরে

সে আর সে

তারা-

কতক্ষণ চুপ করে ঠায়

কাজল মেশানো জল টলটল করে এ পাড়ায়

আজ রাতে ভিজে আসি চল

দুপুরের শীতজ্বরে পুড়ে গেলে সমূহ আগুন

তোকে বলি-

একটা টফিও আমি খাইনি কখনও কোনদিন

বিশ্বাস কর-

জমিয়ে রেখেছি সব কবরে ছড়িয়ে দেব বলে!

প্রমোদশহর

প্রকৌশলে আছে স্তব্ধ শহর

একমুখী বৈদুর্য-শহর সাজানোর ব্যস্ত কারিকুরি

হাওয়ায় দুঃখ লাগে তোমার

চাঁদেও দুঃখ পাও

বিগতযৌবনা?

তোমার

মস্তিষ্ক থেকে শুরু করি

সংবিধান-স্বীকৃত মুখমণ্ডলে

জ্যোৎস্নার বিরল কাটাকুটি-

সারাতে তাপ নাও, নিদ্রা নাও প্রবীণ ত্বকে

তরুণ

করুণ

মোলায়ম লোমকূপে

সন্ধ্যা ঘনায় আশ্চর্য মনীষায়……

হে শহর

প্রতি রাতে

তোমার পা-দানিতে

উল্লাসের তীব্র সংগীত শোনায় কেউ

তোমার দুরন্ত শারীরিক ঢেউ

গোটা পৃথিবীকে

অ্যামিউজ়মেন্ট পার্ক করে তোলে!

সমাজবিরোধী

কেন তুমি বিরোধিতা করবে সমাজের?

তুমি তো পলাশ তুমি মন্দার—

কেন তবে বিরোধিতা করবে আমাদের— বলো, বলো কেন?

এ সকাল তোমার আমার

এ রাত্রি বেঁচে থাকবার

এসো হাত ধরো

সানি লিওনিকে গিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বলো—

“ঐ স্তন তুমি বিক্রি ক’রো না… শোনো মেয়ে—

মাতৃরূপেণ ঐ দুধের দু’ফোঁটা তুমি ঢেলে দাও

হাড় বের করা গোটা পৃথিবীর বিরাট হাঁ-মুখে

মা তুমি…

মুছে দাও সন্তানের সমস্ত ক্ষত

সমাজের পক্ষে দাঁড়াও!

সমাজবিরোধী তুমি নও; আহা তুমি নও– সবাই জানুক!”

গুণ্ডারা শুনে যাও—

তোমার দু’হাতে যত তলোয়ার, 47, বোমারু হিংসা রয়েছে

এসো সব জড়ো করে তুলি

যে কৃষক

নিজের ক্ষেতের মাটি চিবিয়ে চিবিয়ে, মরছে একটু একটু

তার মাটি চাষ ক’রে ফসলের সুগন্ধ তার ও পাঁজর ভ’রে দাও…

ধানের গন্ধ রোজ দুয়ে দুয়ে চাষি যেন বেঁচে ওঠে

নতুন ভোরের সন্ধানে….

এসো

পাষণ্ড নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দাঁড়াই—

সমাজের বিরুদ্ধে নয়!

তুমিই সমাজ

তুমি ভারতের পতাকার রং

কারোর পক্ষে নয়

আজ শুধু নিজেদের পক্ষে দাঁড়াও

নিজের মনের কাছে নত হও…

কে বলেছে সমাজবিরোধী?

সকলে দেখুক

আজ শুধু ‘সমাজের’ পক্ষে আছ তুমি…

——————————————————————

কবি পরিচিতি

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

জন্ম ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ পুরুলিয়া। বাবা সুপরিচিত কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় মা গীতা গঙ্গোপাধ্যায় । ছোটবেলা থেকে লেখালেখি শুরু। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখাতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত । লেখেন কবিতা ছড়া গল্প প্রবন্ধ ও উপন্যাস। অনুবাদ সাহিত্যেও বেশ কিছু কাজ করেছেন। অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত কবিতার কাগজ কেতকী পত্রিকা সম্পাদনার সাথে সংযুক্ত রয়েছেন।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর। পেশায় দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে Asstt. Controller পদে কর্মরত।

প্রকাশিত গ্রন্থ

কবিতা

১ সুসংবাদ কিনতে যাব

২ হাইফেন বসানো বারান্দা

৩ বিভ্রম রঙের মেঘ

৪ আঁধারে অঘ্রাণে

৫ অপেক্ষা খরচ করি

৬ দূরত্বের প্রতিধ্বনি

৭ নিরুত্তর প্রশ্নের দ্রাঘিমা

গল্প

১ প্রান্তিক জানালা ও অন্যান্য গল্প

২ ….. এবং অস্পৃশ্য হাত

উপন্যাস

১ আক্রান্ত বৃষ্টিদিন

২ নির্জনের আলোবাড়ি ( প্রকাশিতব্য)

৩ মাটির মহক ( প্রকাশিতব্য )

শিশুসাহিত্য

রাঙা মাথায় চিরুনি ( ছড়া)

পুরস্কার

ত্রিবৃত্ত পুরস্কার

মালীবুড়ো স্মারক সম্মান

মন্দাক্রান্তা পুরস্কার

পূর্বাশা এখন পুরস্কার

কফিহাউস পুরস্কার

জিরাফ পুরস্কার

বর্ষসেরা সাহিত্যসম্মান (খড়গপুর মহকুমা তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ)

নবপ্রভাত রজতজয়ন্তী পুরস্কার

উন্মেষ পুরস্কার

অণুপত্রী পুরস্কার ইত্যাদি

মেঘের আঁচল থেকে

এক

কালো দাগ মুছে ফেলা গোপন অসুখ

মীমাংসাবিহীন তুমি শুয়ে আছো আজ

ক্যালেন্ডারে ঝরাপাতা,

উড়ন্ত আঁচল দিয়ে ঘেরা এক নির্মম বুননে

জলশাঁখ বেজে ওঠে বুকের কার্নিশে

শব্দ ছিটকে যায় ফুঁ য়ে

ব্যথার অপ্রেম স্পর্শ শরীরের ভাঁজে বিষ

নীলকণ্ঠ সহিষ্ণুতা বোবাজলে ডুবেছে আবুক

চলে যাচ্ছে অগভীর

সদুত্তর প্রশ্নের দ্রাঘিমা

অপরাহ্ণে দলছুট আলো

দুই

মাঠ বলতে সবুজের সমারোহ

টুকরো টুকরো আলো এসে

তার গায়ে নির্জন স্বাক্ষর রেখে যায়,

তখন কারুকাজ করা মনখারাপ ছিটকে যায় দূরে

ঐ নদীর কিনারে

বৃষ্টির জানলা খুলে কেউ এলো

তার হাতে বন্ধুত্ব স্মারক

বিদ্যুৎলতার মতো এক ঝলক ক্ষনজীবি সুখ

বারণরেখা

চারপাশে এ আমির আলিঙ্গন

টপকে যেতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ আয়োজন

ফিরে আসে ব্যক্তিগত জ্বর

স্বপ্ন ধার দাও তুমি সরোবর ,

বলে হাত পাতি যে তুমুল জলের বিভ্রমে

সে ও কোনো আমি , আমিই তো ,

উগরে দেয় আমার মতন এক প্রতিবিম্ব

অবিকল আমার মায়াবী ক্লোন

চৌকাঠে বারণরেখা অতিক্রমহীন ।

ঈশ্বরদা

কান্না পেলে চোখ মুছে হাসি হাসি জানলা খুলে রাখি

ঈশ্বরদা আসবেন

আজ তার নিজস্ব শব্দে বর্ণপরিচয়ের উপর আঙুলের ছায়া দোলে

অ এ অন্ন

আ এ আকাশ

ভাঙা জানালায় আলো টাঙিয়ে দেয় কেউ

চোখের জলে অক্ষরগুলো ফুল হয়ে ফোটে

ঈশ্বরদা আমার প্রতিবেশী

অক্ষরের গায়ে পেনসিল বুলিয়ে আমি ভালোবাসা লিখি ।

—————————————————————–

কবি পরিচিতি:

রাজীব মৌলিক

গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা। এযাবৎ প্রকাশিত বই একটি”মেখলা ক্যাকোফোনি”২০১৯,প্ল্যাটফর্ম প্রকাশনী।কৃত্তিবাস, মাসিক কৃত্তিবাস, বৈঠকী আড্ডা সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখেছেন।

চুম্বন

চুম্বনের কোনো যতিচিহ্ন থাকেনা

দু’একটি বেদনাগ্রন্থির ফুল ফুটে থাকে

দু’একটি মৃতপ্রায় লবণাম্বু জন্মে স্মৃতির কোরকে

এ দিন, দিন নয়

যেখানে অফুরন্ত হাসি নেই

নির্জনতার মাঝে ধবধবে মুখ নেই

বিচ্ছেদের অলঙ্কার পরে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে

ওর ডাকনামে মিশে আছে সূর্য ফাঁটা ঘ্রাণ

তবু হেসে কথা বলে-

নারীরা সবদিন হেসে কথায় পটু

হয়তো হেসে কথায় প্রমাণ করতে চায়

তার ঠোঁটে কোনো চুম্বন লেগে নেই

জল

বেদনা আঙুর ফলের মতো রসালো

যত চেপে ধরি জিভ দিয়ে

চোয়াল ফেটে বেরিয়ে আসে জল

সে জলে সাঁতার কাটে এক সাদা ওড়না

সে জলে ডুবে যায় তপ্ত উঠোনের রেশ

এমন হয় ; দুঃখের খইয়ে মাঠ ভরে এলে

বাতাবিলেবুর মতো স্বাদ যার

তাকে মনে হয় বিষণ্ণ দুপুরের ছাদ

এই ছাদ ডিঙিয়ে একদিন তুলে এনেছিলাম

বারোমাসের মেঘ

যার ছায়ায় ছায়ায় লেগে আছে আজ

আমারই জল

 খুনী

একটি পিঁপড়েকে হত্যা করলে খুনী হবেনা

একটি মাছিকে হত্যা করলেও খুনী হবেনা

অথচ একটি ভালোবাসাকে হত্যা করলে খুনী হবে

একটি মনকে হত্যা করলে খুনী হবে

সে পিঁপড়ে হোক

আর বন্য শূকর কিংবা মানুষ

যার হৃদয় আছে

তাকে হত্যা করলেই তুমি খুনী

——————————————————————

কবি পরিচিতি

তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম- ১/০৯/১৯৯৬। গত বছর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েছেন। ২০১৫ থেকে সক্রিয়ভাবে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নানা ছোটোপত্রিকায় লেখালেখি করেন। ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই ‘ঘুম দাও ঈশ্বর’, পেয়েছেন ‘সোনাঝুরি কবি সম্মান-২০১৯

কিংবা আহুতি

খানিকটা নরম অসুখ মাটিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে!

তুলে নিতে গেলেই দেখি,

শরতের শিশির।

যে রাস্তায় সহজে হাঁটে না কেউ

সেই রাস্তার পাশে

প্রথম প্রেমিকার চোখের মতো ফুল ফুটে আছে…

শান্তি ডুবে যাচ্ছে জলে।

সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখি,

হারিয়ে যাওয়া মাছ!

অথচ সুখ এই যে,

মাছ এবং চোখ

কাউকেই দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে পারবো না…

একটি আবিষ্কারের কাহিনী

ফেরার কথা ছিলোনা, অথচ সেদিন সকালেও কাচে জলের ফোঁটা ফেলে দেখেছে কীভাবে সূত্র কাজ করে। বিক্ষিপ্ত আলো খেলনাপাতি খেলতে গিয়েছিল পাশের বাড়ি, ডেকে এনেছে তাকেও!

এখন ছককাটা বারান্দায় রক্ত আর বুগেনভিলিয়ার রঙ এক হয়ে গেলেই সে নিশ্চিত হবে, অতি প্রেমিক এবং এস্রাজ একই মুদ্রার দুই পিঠ।

গাঢ়

 একটা শুকনো সেতার ক্রমাগত বেজে চলেছে কানের পাশে।

চোখের বাইরে কীসের ছায়া পড়ে,

পাখি বলে ভুল হয়, পুনরায় সামলে উঠি!

এই বুঝি গোপন হাত যা ধরবার জন্য এত তাড়াহুড়ো!

নক্ষত্র জানে না আকাশ কখন তার দিকে আঙুল তুলে বলবে – ‘কে তুমি? এখুনি ছেড়ে দাও ঘর…’

একটা শুকনো আলাপ, বুকে কাছে খসখস শব্দে ঘোরাফেরা করছে!

বাইরে বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে উচ্ছ্বসিত পাতাদের দলে নাম লিখিয়েছে পুরনো শোক!

ওমন গাঢ় সবুজ শোক এর আগে দেখিনি নিশ্চিত…

——————————————————————

কবি পরিচিতি

তুষারকান্তি রায়

আজ বাংলা সাহিত্যের একটি নিয়মিত নাম তুষারকান্তি রায়। কৈশোরে ‘ আরশি ‘ পত্রিকায় লিখে কবিতার জগতে এসেছেন। দেশ, কবিতা প্রতিমাসে, এই সময়, কবি সম্মেলন,  শহর,  কৃত্তিবাস,  নতুন কৃত্তিবাস, আজকের সম্পূর্ণা, সহ বাংলার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লিখে তিনি সাহিত্য চর্চার মূল স্রোতে যুক্ত রয়েছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলি হলো =  সৃজন তুমি লিখতে পারো না তো (  প্রতিভাস ) ,  আলাপী শিশির ( প্রতিভাস ),  বাউলের বারোকথা ( সিগনেট প্রেস ), অকাল কিশোর ( পাঠক ),  সন্ধ্যা তারার গন্ধ ( সপ্তর্ষি ) , কিউমুলোনিম্বাস ( সুতরাং ),শোনো রাধারানি ( অভিযান পাবলিশার্স ),  অন্যরোদ ( প্ল্যাটফর্ম )।

      প্রকাশিত উপন্যাস =  দাহপুরুষ (  অভিযান পাবলিশার্স),   তীর্থংকর মল্লিনাথ (  অভিযান পাবলিশার্স )

অনর্থ

ধরো আঘাতেও বাজলো না সপ্তসুর;

প্রাসঙ্গিক শব্দের খানা খন্দে

নাছোড় রাশিফল , জল , বয়স !

স্তব্ধ সন্ধ্যার মুহূর্ত ।

জনতা এক্সপ্রেস ?

সে তো দেরি করেই আসে ; তবু দ্যাখো

তাঁর পাঁজর ভর্তি যুবমেঘের হুল্লোড় ,

ডানা খোলা শ্রাবণ সংক্রান্তির গমগম কথোপকথন ;

ওরা কী ইউক্লিডের উপপাদ্য জানে ?

মহুয়া ফুলের গন্ধ ?

আমি দশকথার হাওয়াগাড়ি চালাই,

বাঁকের পর বাঁক পেরিয়েও বাঁকের নেশা যায়না !

বনগন্ধে ভরা ঢুলুঢুলু অর্গান বিধুর এই মন !

তর্ক কোরো সোনামন ! এসো

আসন্ন মল্লারের পাঠ্য বিষয়ক উপাখ্যান প্রস্তুত করি ,

গূঢ় বার্তার স্বর – ব্যঞ্জনে লিখে রাখি

অনর্থ , কথাপুরের মাজাকি , ভাঙচুর , আর

শৃঙ্খলাহীনের সংহিতা , দ্যাখো

আকাশে বিষবৃক্ষের চাঁদ

দুরত্ব

বসন্ত চলে গেছে , এখন 

রুখু বাতাস প্রসঙ্গে কথা বলবার সময় ।

শুভেছা ! জানো তো , সকল 

লেখার মধ্যেই কত কাটাকুটি থাকে !

যেমন চাঁদের কপালে রাহু , তথাপি 

প্রশস্তি শোনাতে গিয়ে কত মুদ্রা, আর

 কথার বিদ্যুৎ

 আমি হারিয়ে ফেলেছি 

মেঘে ও আষাঢ়ে –

যদি অনুমতি দাও , পুনশ্চ লিখি 

          মুদ্রা

শেষ পঙক্তির পরেও 

যতিচিন্হের সংকেত শ্বাস – প্রশ্বাস । বাঁশি 

অথচ দ্যাখো , হর্ষ লেখার 

বর্ণ সরে গেলে অক্ষরে অক্ষরে 

আছড়ে পড়ে বেখুদি , আমি 

সার্কাসে ভালুক নাচের মুদ্রা 

নিয়ে খেলতে খেলতে 

ছড়িয়ে পড়ি জলের নিয়মে 

নতুন কাগজে । 

——————————————————————–

কবি পরিচিতি:  

কবি বিকাশ চন্দ

জন্ম ১লা এপ্রিল ১৯৫৫

জন্মস্থান, খেজুরী থানা, কামারদা। 

এখন “মানসভূমি”, কাঁথি, কুমারপুর, পূর্ব মেদিনীপুর। সূচক ৭২১৪০১, মোবাইল ৯৪৭৪৫৯৯৭৭৪ 

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত। ভারত। 

প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ  ঃ—-

১. বীজে অঙ্কুরে বিনষ্ট শিকড়ে (২০০৭) ২.বর্ণ বিহীন বর্ণ বিকাশ (২০১৬)

৩. ঋতু বদলের ছবি (২০১৭)  ৪. আকাশ গঙ্গায় নক্ষত্র ভেলা (২০১৭)

৫. বিষণ্ণ দ্রোহকাল (২০১৮) ৬.শূন্য শরীরে স্থপতির হাত (২০১৮)

৭. সাদা ফুলের কফিন(২০২০) ৮. অনুচ্চারিত শব্দের কোলাহল( লকডাউনে আটকে আছে)

এসো বকুল সই 

~~~~~~~~~

চিরকাল জেনেছি মৃত্যুর অবয়ব বন্ধ চোখ

কোনও বিকার মারাত্মক কোন অশনি সংকেত নেই, 

হৃদয়ের ভেতরে চুপচাপ ঘুমিয়েছে স্পন্দন—

নিম গাছ তুলসী শূন্য তক্তাপোশ ঝিমুচ্ছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ

প্রতিবাদের রঙ ছিল না তবুও রাজা পাতাল ঘরে—-

এই শূন্যতা কী রঙ চিনেছিল হে মহাত্মন ! 

যেখানে যত বকুল গাছ সেখানে বসন্ত বারো মাস

কোকিল কোকিলার ডাক আবহমান—

যে মানুষটা চিরকালের জন্য ঘুমোল

তার পঞ্চইন্দ্রিয় নিঃশব্দ সেও শুনেছিল, 

চির বসন্ত সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি—

সে মানুষটা বকুল চাতালে বসেছিল পুষ্প বৃষ্টির জন্য। 

বকুল গাছ সইতে পারে না বিরহ বেদনা—

বর্ষায় সারা শরীর ভিজেছে মন্দাকিনী জলছবি, 

সমস্ত মানুষের আড়ালে চুপিচুপি বসে আছে

তোমার চির প্রিয়তম সেই অবয়ব প্রসন্ন মুখ। 

এই মাত্র ঝলসে গেছে তারই সঞ্জাত বংশ গৌরব—

তা হলে এসো বকুল সই প্রতিদিন এক সাথে হবিষ্যি খাই। 

হৃদয়ে আগুন জ্বালো

~~~~~~~~~~~~~

অনেক দিন হয়ে গেল বসতি পঞ্চাশ বছর

এক একটি জামার ভেতর অনাবৃত শরীর—-

মাটির ঘর তুলসী উঠোন হা-অন্ন নিত্য সহচর

দীর্ঘ সম্পর্ক শুরুর সময় একই স্বপ্নের গভীর। 

তেমন ভাষা যুৎসই ছিল না ছিল শুধু চুম্বন 

তবুও তো প্রেমময় স্বামী সন্তান কখনো দীর্ঘশ্বাস, 

গাছের গহনে ভূমি কন্যা ভ্রমর আদরে ঘুম বন 

মুখ ছবি ছিল জঠর জাতক জানে নিশ্চিন্ত আবাস। 

এখন আবার বুকের ভেতরে চাপ  কেন অন্য আভরণ —

মধুকুঞ্জ কী কেবলই অরণ্য বিলাস রাধিকার, 

কত বার শোকের চিহ্ন ভিজিয়েছে যত গোপন আস্তরন

এখনো ফুল পাখি শস্য মাঠ সবুজ জানায় স্বাধিকার। 

মাটির মোহে স্বর্গ বুনেছি সকল গেরস্ত ঘরের আলো—

কোন কথা নেই তবুও শুনেছি হৃদয়ে আগুন জ্বালো। 

কবিতার শব্দেরাও কাঁদে

~~~~~~~~~~~~~~

যা বলেছিলাম ঠিক তাই এখন কেবল স্তব্ধতা —

এখনও সাজানো আছে খড়্গটা চন্দ্রবিন্দু আঁকা, 

বলি কাঠে শ্যাওলা জমেছে সবুজ—

বহুকাল একান্তে রক্ত মেখেছে অদৃষ্ট লিপি। 

এখন আকাল রক্তের প্লাজমা বভাজনে—

যারা লাল ভালো বাসে না তারাও জানে 

রক্তের রঙ কেবল রক্তের মতো, 

কোনোটা হিম আর কোনোটাতে উষ্ণতা মাখা

একই মা গাছে জড়িয়ে অভিন্ন শাখা প্রশাখা। 

কবর খুঁড়ে মানুষ ঘুমালেও কান্না আত্মজনের—

হবিষ্যি কালে শূন্য চিতায় আঁকা মানুষ পুতুল, 

নিঃশব্দে একেকটা বাঁধন আপনি ছেঁড়ে

জীবনের স্বাদ খুঁজতে চাইলে ছিঁড়ে যায় নাড়ি। 

চৌকোনা সাদা কাপড় আর সরষে ফুল—

আবার আবাদী জমিনে ঘুমোয় অনাবাদী শরীর। 

ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খায় ঢেকে রাখে বাড়ি

কবিতার শব্দেরাও কাঁদে  বেহালার তারে।

——————————————————————–

কবি পরিচিতি

সৌমাল্য গরাই

জন্ম ১ লা জুলাই, ১৯৯৬।

বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, নাকাইজুড়ি। সেখানেই তার জন্ম, সেখানেই শিক্ষার সাথে বেড়ে ওঠা। বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ হয়ে বর্তমানে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তরে পাঠরত। কবিতাই তার নিভৃত আশ্রয়, বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবি লিখে চলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম দেশ, কবিতা আশ্রম,কৃত্তিবাস, শ্রীময়ী, লালমাটি, রুখুডি ইত্যাদি।

নিখোঁজ

অন্তর্বতী স্নায়ুযামে

কিছু ঋতু স্থির হয়ে বসে

প্রখর গ্রীষ্মের মধ্যে   পোড়ে আত্মকামী

কখনো বৃষ্টিতে খুঁজে পায় না নিজেকে মেলে ধরবার ছাতা

হেমন্তের মতো লুকায় জীবন 

মর্মব্যথাকাল

যে চলে গিয়েছে এক অজানা ঋতুতে

তারও গহীন লোক হারিয়েছে 

নিখোঁজ মানুষ জানে না আসলে, 

পুষে রাখে  রাত 

ঋতুচক্রহীন পথে

শেষে নিজেকেই খুঁজে পায় না হঠাৎ 

শান্তি সংহিতা

যতক্ষণ আঁকড়ে থাকো আঙুলভর্তি আলো। বিষণ্ণ জাহাজ থেমে গেলে হাওয়া চুপ হয়। বাগান হয়ে ওঠে কলকাতা। চড়ুই রোদ্দুর থেকে নরম পাখিটি গালে এসে বসে, বাসা বানায় তোমার চুলে।

দিকচিহ্ন হারায় নবীন সারেং। সময় অপরাধী হয়ে যায় এসময়। এমন স্তব্ধতা থাক যেন মুছে যায় হাতঘড়ি। অদৃশ্য চুম্বন ভেঙে তৈরী হোক আয়না পৃথিবী—যেন প্রতি জন্মান্তরে তুমি এক  তারাবিম্ব। মহাশূন্যে বিস্মৃত সময়ের অসীম চোখ নিয়ে চেয়ে আছো—বুদ্ধের শান্তির মতন.. 

২.

তৃতীয় নয়ন থেকে এসেছ—নিদ্রা গেলে যে চোখ স্বপ্নকে দ্যাখে। আমি স্থির পরিব্রাজক—শান্ত দুই হাতে

মুঠো আগলে রাখি। প্রস্থান ফিরে আসে

পরিচর্যা পেলে রোগও ওষুধ হয়ে ওঠে। গ্রহদোষ কেটে যায় পৃথিবীর। নিঃশব্দে জানাই 

ভাষার হরিণী, নিঃশ্বাস বাঁচিয়ে রেখো—  আমি তো সামান্য ব্যঞ্জনবর্ণ, তোমার স্বর ছাড়া উচ্চারিত হতেই পারি না

বাস

নতুন মানুষ তুমি উঠে এসো ধীরে

পথবহনের দায়, কোলাহল বুকে নিয়ে শুয়েছে ডাঙার মাঝি

  জীবন্ত গৃহটি যেন ছুটে চলেছে দুর্বার

 যতক্ষণ ভার, নিবিড় আনন্দে ভারী হয় বুকের কষ্টটি

তুমি, নেমে গেলে ব্যথা…

গন্তব্য নিকটে এলে তাই

গোঙানির শব্দে কান পেতে রাখা দায়

——————————————————————–

কবি পরিচিতি

সোহম চক্রবর্তী

ঠিকানা – কৃষ্ণনগর, নদীয়া

বয়স – ২২ বছর

পেশা – স্নাতকোত্তরের ছাত্র

কাব্যগ্রন্থ – নির্জনতাগুচ্ছ (২০১৯), আদম প্রকাশনা

লেখা প্রকাশ – মুদ্রা, জীবনকুচি, আলোপৃথিবী, তবুও প্রয়াস, কথাকৃতি, আনন্দম্ সহ বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে

পা-ফসকানো টিকটিকিটা

পা-ফসকানো টিকটিকিটা ফ্যানের ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে

ছিটকে পড়ে – এই দেখে সব নাগরদোলায় ভয় পেয়েছি,

অমনি যদি… অমনি যদি চুলচেরা বুক নিয়েও আরও

মিনিটকয়েক শ্বাস নিতে হয়? লোকজন কেউ পাশ কাটিয়ে

দিব্যি চলে, কেউ বা আবার লেজটি ধ’রে দূর ক’রে দেয়…

ঠিক তখনও… ঠিক তখনও তোমার কথাই ভাবতে হবে –

গলার কাছের ধুকপুকে প্রাণ যেইটুকুনি আটকে আছে,

থাকবে না আর একটু পরেই – এই কথাটাই ভাবতে হবে,

কিন্তু তুমি থাকবে ভীষণ ভিতর ভিতর – অথচ নেই…

সমস্যা এই দুইটি আলোর মধ্যিখানে ঠায় দাঁড়িয়ে

নখ খেয়ে যায়… অন্ধকারে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে –

একটি জীবন ঘুরিয়ে মারে দুর্বিপাকে, নাগরদোলায়;

আরেকটি স্রেফ শিউরে ওঠে টিকটিকিটা মরার আগে…    

সীমা

তক্ষুনি ঠিক পাথর করে

ঝুলিয়ে রেখে গেলে

ঠোঁটের কাছে নিরীহমতো

ছোট্ট সেমিকোলন…   

সকল গৃহ হারালো যার

আমার ঘুমের ভিতর ছোট্ট একটা ঘর আছে।

একফালি খাটিয়ার পাশের টেবিলে

জল-টল কিছু একটা রাখা…

আমি ঘুমিয়ে পড়লেই কেউ একটা ঢোকে –

খাটিয়ায় শুয়ে থাকে চুপচাপ, ভয়ের স্বপ্নে চমকে উঠে

পাশের টেবিল থেকে জল গড়িয়ে নেয়;

ভোর-ভোর বেরিয়ে যাওয়ার তাড়ায়

দরজা দেয় এতজোর – যে সেই শব্দেই আমার ঘুম ভাঙে,

চেয়ে দেখি পাখি ডাকছে, জানলায় জানলায়

উপচে পড়ছে রোদ…

অর্থাৎ, আমার জন্যে লোকটি আজও বাস্তুহারা হ’ল।

——————————————————————–

কবি পরিচিতি:

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – সিলভার লাইনিং (জ্বলদর্চি প্রকাশনা), লাভ ক্যাপুচিনো (যৌথ)( অভিযান পাবলিশার্স), এ জীবন ক্রিকেট-লিখিত ( হাওয়াকল প্রকাশনা), পর্ণগ্রাফিত্তি ( প্ল্যাটফর্ম প্রকাশনা)

সম্মান / পুরস্কার – তারাপদ রায় সম্মাননা (নতুন কৃত্তিবাস), বইতরণী সম্মাননা ‘এ জীবন ক্রিকেট -লিখিত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য।

ত্রি

১. 

আলোয় ফোটে না যত কিছু, তাকে আমরা

                                       দুঃখ বলে চিনি

তার উপর তা দিই, বসে থাকি ভাঙবার লোভে

কে বসেছে ছক পেতে পুরানো শত্রুতা ঘিরে?

তাকেই প্রণাম করি নিভে যাওয়া কণ্ঠনালি চিরে

২.

হাওয়াটি উঠবে ডেকে – এই তার মুদ্রাদোষ

যদিও জেনেছে লোকে, এ স্বভাব ভাল নয়

কে কখন চলে আসে,  ভূত-প্রেত-পরী কিংবা জিন

মানুষের সমবায়ে হাওয়াটিও অশরীরি 

                          অন্যার্থে মায়াবী, প্রাচীন

৩.

জলকে স্বীকার করো

মানো, এই জলের পরিধি থেকে দূরে

কেউ যেতে পারবে না কোনোদিন

জলকে ভয় পাও

জলের হাতেই দিও অসমাপ্ত ঘটনাপ্রবাহ

কিছু নয়–কিছু নয়

জলের ভেতর আছে সমস্ত নিবিড়ের দাহ

——————————————————————–

কবি পরিচিতি

শুভদীপ সেনশর্মা

প্রথম দশকের তরুণ কবি শুভদীপ সেনশর্মার জন্ম ০৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ কাটোয়ায়। কবিতায় আত্মপ্রকাশ ‘সবাই রাজা’ পত্রিকায় ২০১০ সালে। পরবর্তীতে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দেশ, ভাষানগর, আদম, তিতির, ছাপাখানার গলি, শুধু বিঘে দুই সমান্তরাল ভাবনা, বীরুৎজাতীয় পত্রিকা, ফিনিক্স, কথক, আলোবাতাস সহ দুই বাংলা আরও অনেক লিটল ম্যাগাজিন ও ব্লগজিনে। কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও প্রচ্ছদ-অলংকরণ করে থাকেন। নেশা চুটিয়ে গল্প করা, পুরাতন পত্রিকা সংগ্রহ করা, পুরাতন বই সংগ্রহ করা, বই পড়া, গান শোনা। দশ বছর ধরে সম্পাদনা করে আসছেন আলোপৃথিবী কবিতা পত্রিকা। ‘আলোপৃথিবী প্রকাশনা’ র কর্ণধার এই কবির এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দুটি – নির্বাক বাল্মীকি (বীরুৎজাতীয়, ২০১০), রজত সেন (বার্ণিক, ২০১৯)।

মা

আমার মন্দিরে যে দেবী থাকেন তাঁর কোনো নাম নেই

সে অলিন্দের গভীরে বিচরণ করেন

কতবার ভেবেছি তাঁকে নাম ধরে ডাকব

কতবার ভেবেছি তাঁর একটা নাম রাখব

আমার মন্দিরে ফুল নেই; প্রসাদ নেই

একমাত্র আমি ছাড়া…

মা’কে দেবীর ছায়ায় আগলে রাখি

যেভাবে মন্দিরে থাকেন দেবী

মাকেই দেবী বলে ডাকি

অশ্রুজাত বালক

এখন এখানে কোনো কবিতা লেখা হচ্ছে না

বিপন্ন সমস্ত মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে বালক

বালক সব জানে

ধূসর কাঁধে ঝুলে থাকে অন্তর্জলী কবিতার

উদাস পাণ্ডুলিপি

অন্ধ এই রাতের দিকে তাকিয়ে আমাদের বালকের স্বপ্ন

বসন্তের ছায়া আগলে রাখে চন্দ্রাহত কবির শরীর

এখন এখানে কোনো কবিতা লেখা হচ্ছে না

বানান অভিধানের পাতা উল্টে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা

বানান সংশোধন করছে অশ্রুজাতক বালক

বালক সব জানে

হারিয়ে যাওয়া বকুলফুল কুড়োতে কুড়োতে

এক বাংলার জ্যোৎস্না জন্মহাড়ে খুঁজে পায়

উদাসীন প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়ে সুন্দর বালক

গোপনে গোপনে কখন একটা দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলে

তোমার কল্পতরু ছায়া

তোমার ছায়ার পাশে কল্পতরু গাছের ওম

অত্যাবশক প্রাণের হৃদকম্পনে ভেসে যাচ্ছে কল্পতরু

তবে এখানে মাটি কোথায়?

গঙ্গাজলে মাটির স্তব থেকে ধূলিকণা উড়ে যায়

পড়ে থাকে অনিঃশেষ শূন্যতা

আমার অন্ধকার ঘরে

বেদনাসিক্ত হাওয়া

মৃতদেহের ছাইয়ে একফোঁটা গঙ্গাজল ফেলে দেয়

আমার শরীর পাশে কল্পতরু জীবন

আমার দেহের ভারে প্রত্যাশিত পৃথিবী

আমার পদতলে প্রক্ষালিত অন্ধকার

আমার আর তোমার হারিয়ে যাওয়া

ধূপের ধোঁয়ার মতো বাস্তব

——————————————————————–

কবি পরিচিতি:

নীলাদ্রি দেব

জন্ম 14 এপ্রিল, 1995. কোচবিহারে (পশ্চিমবঙ্গ).

শারীরবিদ্যায় স্নাতক. যুক্ত আছেন শিক্ষকতায়. 

কবিতাবই- ধুলো ঝাড়ছি LIVE, জেব্রাক্রসিং ও দ্বিতীয় জন্মের কবিতা, এবং নাব্যতা. 

সহ সম্পাদিত পত্রিকা- ইন্দ্রায়ুধ, বিরক্তিকর

রাতের রেওয়াজ বা অমূলক কবিতা 

নয়. 

পশুপতিকে আঁকতে থাকেন অরণ্যদেব 

তীব্র হরিণপোকা শিস দিয়ে যায় 

সাপের মুখে ব্যাঙ ও ব্যাঙাচি 

চাঁদের শেষ আলোয় খাদ্যশৃংখল 

প্রকাণ্ড এক রাতশামিয়ানার নিচে 

  প্রকৃতিকে আঁকতে থাকেন পশুপতি ও অরণ্যদেব

দশ. 

নদীখাত ভেঙে, উল্টে কত জল বয়ে যায় অনির্দিষ্টকাল 

দেহজুড়ে অবিন্যস্ত সুরের সংলাপ 

ঢেউ আর মেঘেদের ছায়া 

      কত বিমূর্ত ছবি তৈরি করে 

থোপা থোপা পানাগাছ বয়ে যায় অজানা জাদুতে

কাছে আসে বৈঠার গান 

নৌকোর দুলে ওঠা মাঝি শুধু বোঝে!

জীবনের পালে মিহিসুতো দৃঢ় করে পার ও জমিন

বারো

বর্ষায় শীতের একটা আমেজ থাকে 

শীতে বর্ষার 

জীবনে কুয়াশার একটা স্পর্শ থাকে 

কুয়াশাতে জীবনের 

আরও অনেক কিছুই এমন জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁচে

মানুষ দেখে 

শুধুই দেখে 

এরপর অন্য কিছু দেখার জন্য স্তব্ধ থাকে 

বাহানা খোঁজে 

           অনেক সময় পাতার ছায়ায় 

      নিজের মুখের আদল দেখে আঁতকে ওঠে

————————————————

Design a site like this with WordPress.com
Get started